catechu: পানের খয়ের কীভাবে তৈরি হয়? জেনে নিন প্রাকৃতিক খয়েরি রং তৈরির পদ্ধতি

।। প্রথম কলকাতা ।।

catechu: পান পাতার মাঝে একটু খয়ের আর চুন, ব্যাস তাতেই জমে ক্ষীর বাঙালির গল্পের আসর। গ্রাম বাংলার বাতাসে মিশে আছে পান খয়েরের ঐতিহ্য। এখনো পর্যন্ত সেই ঐতিহ্য অটুট রয়েছেন। বিয়ে বাড়িতে রীতিমত পানের আসর বসে যায়। যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ খয়ের। রামধনুতে কত রঙের খেলা, কিন্তু এই খয়েরি রঙের দেখা পাবেন না। তবে প্রকৃতি কিন্তু কোন খামতি রাখেনি। রামধনুতে না থাকলেও একটি গাছ থেকে এই খয়েরি রং পাওয়া যায়। শুধু পানের জন্য নয়, কাপড়ের খয়েরি রং তৈরি করতেও খয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কীভাবে তৈরি হয় এই খয়ের, জানা আছে? খয়ের কি সরাসরি গাছ থেকেই পাওয়া যায়? এটি গাছের কাণ্ড, ফুল না পাতা?

বিজ্ঞানীদের ভাষায় খয়ের গাছের নাম একাশি ক্যাটেজু। এটি দ্বিবীজপত্রী গাছ। সাধারণত গাছের বয়স ১৫ বছর হলেই সেখান থেকে খয়ের সংগ্রহ করা যায়। বাংলার লোকগানের সঙ্গে মিশে রয়েছে “নিম তিতা নিশিন্দা তিতা, তিতা পানের খয়ের”। এর থেকেই বলা যায় পানের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হল খয়ের। খয়ের গাছ প্রাকৃতিক রঙের উৎসের পাশাপাশি দিয়ে আসছে নানান কঠিন রোগের ওষুধ। খয়েরের আবার বিভিন্ন নাম। বিশেষ করে তাম্বুল বিলাসীদের পানের সঙ্গেখয়ের না হলে চলে না।

পান ছাড়াও কাপড়ের ব্যবহৃত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রঞ্জকের উৎস হলো এই গাছ। এই গাছের মাঝখানের সারাংশ থেকে পাওয়া খয়েরি রং মাছ ধরা জাল, দড়ি রং করতে ব্যবহার হয়। এছাড়াও এই রঙ দিয়ে তৈরি হয় ছবির ক্যানভাস। গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খয়ের গাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়। দাঁতের সমস্যা, কাশি, ফোঁড়া, আমাশয়, শ্বেতি প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে খয়ের বেশ কাজেরয। শ্বেতি হলে অনেকে খয়ের গাছের কাঠ সিদ্ধ করে দুধে মিশিয়ে খান। কাশি কিংবা মেদ কমাতে এই গাছের কাঠ সিদ্ধ জল বেশ উপকারী। যদি মুখ থেকে খুব দুর্গন্ধ বের হয় কিংবা দাঁতের মাড়ি ফোলে তখনও খয়ের ভেজানো জল খেলে রোগের উপশম হয়। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খয়ের খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

মাঝারি আকারে পর্ণমোচী বৃক্ষ। উচ্চতা বড় জোর ১৫ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত। ফলগুলো সিমের মত চ্যাপ্টা, সাদাটে। চৈত্র মাসের দিকে গাছের ফুল আসে, আর পৌষ মাসে গাছে ফল পাকে। তবে খয়ের উৎপন্ন হয় এই গাছের কাঠ থেকে। বাংলা এটিকে খয়ের বলা হলেও আরবি ফার্সি উর্দু কিংবা হিন্দিতে একে বলা হয় ক্বাথ। এর পাতা বাকল অনেকটা তেঁতুল গাছের মতো দেখতে এই গাছের কাঠের ভিতরের অংশ একেবারে রক্তবর্ণ। গাছ চিড়লে মনে হবে ভিতরে যেন কেউ খয়ের ঠেসে রেখেছে। প্রথমে এর পরিপক্ক গাছ কেটে ছোট্ট টুকরো টুকরো করে ভাগ করে নেওয়া হয়। তারপর সেই ছোট্ট কাঠের টুকরো গুলি কুচি কুচি করে কাটা হয়। সেগুলি জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে বড় বড় মাটিতে মাটির হাঁড়িতে ভরে সিদ্ধ করা হয়। এক একটি উনুনে ১০ থেকে ১২টি করে হাঁড়ি বসানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এই কাজ অত্যন্ত পরিশ্রমের। অনেকক্ষণ সিদ্ধ করার পর কাঠের নির্যাস গরম জলে মিশতে থাকে। তলানিতে জমতে থাকে খয়েরের স্তর। সেই খয়েরের রস ভালো করে ছেঁকে আলাদা একটা পাত্রে কয়েক ঘন্টা ধরে পুনরায় জ্বাল দিতে হয়। অবশেষে আগুনের তাপে বেরিয়ে আসে চির পরিচিত খয়ের। ঠিক যেমন ভাবে আখ থেকে গুড় তৈরি করা হয়। আসলে বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ আধুনিকতা দোরগড়ায় থাকলেও এই প্রাকৃতিক রংকে কখনোই অস্বীকার করতে পারেনি। খয়েরের সঙ্গে পানের ইতিহাস ঠিক কিভাবে জড়িয়েছে বা এদের আত্মীয়তার বন্ধন কবে থেকে সেই সম্পর্কে নির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে খয়ের গাছ জন্মায়। এই অঞ্চলে বহু মানুষ আছেন যাদের জীবিকা শুধুমাত্র খয়ের গাছকে কেন্দ্র করে। তবে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। একসময় এই পেশায় যুক্ত ছিলেন প্রায় দুই লক্ষ মানুষ। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী খয়ের গাছ লাগানোর জন্য সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অপরদিকে গাছ পর্যায়ক্রমে কেটে ফেলায় ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে খয়ের বাগান। ১৯৫২ সালে রাজশাহীর চারঘাটের গোপালপুর গ্রামে যে খয়ের শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে।

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version