।। প্রথম কলকাতা ।।
India-Iran Relations: ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পরেই কি, ভারত ইরানের সম্পর্কের অঙ্কটা বদলে যাবে? তাহলে নিশ্চয়ই মনে মনে খুশি হবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানে নতুন প্রেসিডেন্ট এলে, তিনি ভারতের সঙ্গে হওয়া ইরানের সমস্ত চুক্তি বজায় রাখবেন, নাকি বাতিল করে দেবেন? কূটনৈতিক মহলে উঠছে একগুচ্ছ সংশয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের জায়গা শক্ত করতে ইরানের বড় ভূমিকা। সেখানেই এবার কোপ পড়বে না তো? ভারত আর ইরানের বন্ধুত্বের গভীরতা জানলে অবাক হবেন। যেখানে হাজারো চেষ্টা করে ফাটল ধরাতে পারেনি পশ্চিমি দেশগুলো। এবার কোন দিকে মোড় নেবে ভারত-ইরানের সম্পর্ক?
মোদীর পাশে ছিলেন রাইসি, ব্যাকফুটে পাকিস্তান
ইরান এখন যাচ্ছে মারাত্মক খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে। তাদের দেশের স্ট্রং পিলার অর্থাৎ ইব্রাহিম রাইসি আর নেই। খুব শীঘ্রই নির্বাচন হবে, তারপর ক্ষমতায় আসবেন ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট। এসবের মাঝেই কূটনৈতিক মহলে জোরালো হয়েছে একটা প্রশ্ন। ভারত আর ইরানের মাঝে যে চুক্তি হয়েছে, যে সম্পর্ক দৃঢ়তা পাচ্ছিল, সেখানে কি ভাঙ্গন ধরবে? কারণ একটাই, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান নিরপেক্ষ থাকলেও, বিতর্ক কম নেই। বিগত ১০ বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চেষ্টা করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে ইরান। স্বাভাবিকভাবেই, ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর এমন কতগুলো পয়েন্ট তৈরি হয়েছে, যেখানে বড় লোকসান হতে পারে ভারতের।
প্রথমেই আসবে কাশ্মীরের কথা। কিছু মাস আগে পর্যন্ত ইরান আর পাকিস্তানের সম্পর্ক কিন্তু একদমই ভালো ছিল না। একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা পর্যন্ত করতে ছাড়েনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় ইব্রাহিম রাইসির হাত ধরেই জোড়া লেগেছে পাকিস্তান আর ইরানের ভাঙা সম্পর্ক। রাইসি পাকিস্তান সফরে গেলে, পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে যান রাইসি। সোজা কথায়, পাকিস্তান আর ভারতের দ্বন্দ্বের মাঝে ঢুকতে চাননি তিনি। রাইসি কিন্তু আগাগোড়াই ইরান আর ভারতের বন্ধুত্বকে দেখেছেন আলাদা নজরে। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাহলে বুঝতে পারছেন? আজ কিন্তু সেই মানুষটা নেই, তার পরিবর্তে যিনি আসবেন, তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে সমান গুরুত্ব দেবেন কিনা, সেটা বড় প্রশ্ন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ইরানের দুই শত্রু রাষ্ট্র অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক। যদিও ভারত এই কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝে অত্যন্ত ব্যালেন্স করে। যার সব থেকে বড় প্রমাণ, ২০২১ সালে যখন রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্টের পদে আসেন, সেই অনুষ্ঠান সভায় বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে । রাইসির মৃত্যুর কিছুদিন আগেই, ইরান আটক করেছিল একটা ইসরায়েলি জাহাজ। যেখানে ছিলেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাবিক। তাদেরকে মুক্তি দিতে দ্রুততার সঙ্গে তৎপরতা দেখিয়েছিল তেহরান। আর সেটা সম্পূর্ণ কিন্তু ভারতের সঙ্গে থাকা বন্ধুত্বের খাতিরে।
ভারত-ইরান সহযোগী পার্টনার, পরস্পরকে কতটা গুরুত্ব দেয়?
ভারত যদি ভারত আর ইরানের সম্পর্কের গভীরতা চুলচেরা ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে আরো দিক রয়েছে। যে জায়গা থেকে ইরান চাইলেও পিছু হটতে পারবে না। এইতো গত বছরে, যখন জোহানেসবার্গ এ ব্রিকস সম্মেলন হয়েছিল, তখন নরেন্দ্র মোদী দেখা করেছিলেন ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে। সেই সময় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকসের যোগদানের জন্য তেহরানের আবেদনকে সমর্থন করেছিল নয়া দিল্লি। তারপর কয়েক মাস পরেই, আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস সম্মেলনে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় ইরান। ইব্রাহিম রাইসি ভারত এবং শ্রীলঙ্কার সাথে দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও, পাকিস্তানের সাথে কিন্তু সেই সম্পর্কের খুব একটা অগ্রগতি হয়নি, মূলত তার সংগ্রামী অর্থনীতির কারণে। আসলে কি বলুন তো, রাইসি ক্ষমতায় আসার পরেই তার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এশিয়া।
রাইসি তাঁর পূর্বসূরী হাসান রুহানির ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক টানা পশ্চিমা ভিত্তিক কুটনৈতিক পদ্ধতির সমালোচনা করে গিয়েছেন। ক্ষমতায় আসতেই বেশি ফোকাস করেন এশিয়ার উপর। তারপর তো ভারতের সঙ্গে চাবাহার বন্দরের চুক্তির কথা শুনেইছেন। ইরান আর ভারতের এই বন্দর নিয়ে চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, ভারত এই বন্দরের উন্নয়ন আর ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করবে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার আর অবকাঠামোগত উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করবে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার। দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট সুসম্পর্ক রয়েছে বলেই এত টাকার বিনিয়োগ। আর ইরানের চাবাহার বন্দরও ভারতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা ভারতের কাছে বিশ্ব বাজারে দ্রুত প্রবেশ করার অন্যতম একটা পথ। ধারণা করা হচ্ছে, এই বন্দরে ভারতের মোট বিনিয়োগ পৌঁছে যাবে প্রায় ৫০ কোটি ডলারে। বন্দরটি রয়েছে গুজরাটের কান্ডালা বন্দর থেকে ৫৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে। যার মাধ্যমে ভারত খুব সহজে বাণিজ্য করতে পারবে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার দেশসহ ইউরোপে।
যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মুখে ভারতের পাশে ইরান
ইরানের সাথে বন্দর চুক্তির জন্য ভারতকে আবার পড়তে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে। চাবাহার বন্দর চুক্তির মাধ্যমে ভারত এই প্রথম কোন বিদেশী সমুদ্র বন্দর পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার হুমকির সামনেও ভারত সুন্দরভাবে সামলেছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ইরানের সাথে এমনি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে হোয়াইট হাউস ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। ইরানের রাষ্ট্রদূতের কথায়, এই বন্দর চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। ইরানের যুক্তি, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আর ভারত এই বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছে মানে, এই সমুদ্র বন্দর শুধুমাত্র ভারতই ব্যবহার করবে এমনটা নয়। এক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্র চাবাহার নিয়ে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেও থাকে, তাহলে তা ওয়াশিংটনের বিপক্ষে চলে যেতে পারে বলে মনে করেছিলেন ইরানের রাষ্ট্রদূত। তখনো কিন্তু একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্যুতে ভারতের হয়েই কথা বলেছে ইরান।
ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিক দিক থেকেও দুই দেশের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলে, ভারত পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। আর সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইরান। দুই দেশ ১৯৫০ সালে প্রথম বন্ধুত্বের চুক্তির মধ্যে মাধ্যমে স্থাপন করেছিল কূটনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবে দুই দেশের মধ্যে সূচনা হয় এক নতুন পর্যায়ের। নয়া দিল্লি আর তেহরানের মধ্যে বাণিজ্য আর সংযোগ কেন্দ্রিক সম্পর্কও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২.৩৩ বিলিয়ন ডলার। আসলে ২০২১ সালে রাইসি নির্বাচনের পরের অর্থবছরে বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, প্রায় ২১.৭৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের মতে, ভারতের জন্য ইরান পারস্য উপসাগরে কাজ করে একটা স্থিতিশীল উপস্থিতি হিসেবে। আর তাই হয়তো দিনের পর দিন দুই দেশের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামরিক আর নিরাপত্তা সহযোগিতা।
ইরানের পররাষ্ট্রনীতি সর্বদা বলে এসেছে, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং আর্থিক দিক থেকেও তার দৃঢ় করতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে চায়। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের বেশিরভাগ উত্থানপর্বটাই কিন্তু হয়েছে রাইসির সময়। স্বাভাবিকভাবেই, তিনি নেই মানে ,ওই ফাঁকা জায়গায় এখন কে আসবেন, আর তিনি আদৌ ভারতের সঙ্গে সেই সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, যদি একবার চীন রাশিয়া পাকিস্তান আর ইরান জোট বাঁধে, তাহলে চাপে পড়তে পারে ভারত। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে হয়তো আশঙ্কাটা ফলপ্রসু নাও হতে পারে। কারণ ইরানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার যতই হাত বদল হোক না কেন, ইরানের সমস্ত নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে ক্ষমতার শীর্ষ পদে থাকেন ধর্মীয় নেতা। এখন সেই পদে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। রাইসির সময়ও তিনিই সমস্ত নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি ভারত আর ইরানের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট অবগত। তাই হয়তো ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টে এলে, দুই দেশের সম্পর্কে খুব একটা বড় এফেক্ট পড়বে না বলেই মনে করছেন বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম