।। প্রথম কলকাতা ।।
Kolkata market: বড়বাজার (Bara Bazar) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহরের এক ঐতিহ্যশালী বাজার। লোকমুখে শোনা যায় বড় বাজারে নাকি চাইলে বাঘের দুধও পাওয়া যেতে পারে।। গুজব ছিল যে আপনি এখানে ইংরেজি ব্রডক্লথ এবং কাশ্মীরি সিল্ক থেকে শুরু করে সিলোনিজ আইভরি এবং তিব্বতি গরুর লেজ যে কোনও কিছুই পেতে পারেন যদি ভালো করে খোঁজ করেন। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় বাজার কলকাতার এই বাজার। বড় বাজার সুতা ও কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ভারতের বৃহত্তম পাইকারি বাজারগুলির মধ্যে একটি এটি। এই বাজারের নামকরণ শিবের জনপ্রিয় নাম ‘বুড়ো’, তার নামেই করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
১৮ শতকের সময়ে কলকাতার বাজার সুতানুটি হাটের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। সে সময় বাজারটি প্রায় ৫০০ বিঘা জমি ছড়িয়ে গিয়েছিল ও আরেকটি ৪০০ বিঘা আবাসিক এলাকায় আচ্ছাদিত ছিল। শেঠ এবং বসাক ছাড়াও সেখানে সোনার বণিক মল্লিক এবং তাদের সমমানের অন্যান্য সব ব্যাবসায়ীদের দ্বারাই এগিয়ে যেতে থাকে এই বাজার। কলকাতার বড়বাজার মানে একটি বাজার নয়, অনেক বাজার। অনেক গলি গায়েগায়ে লাগানো আস্ত এক মার্কেট প্লেস। পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় সাপ্লাই জোন বড়বাজার হলো পাইকারি ও খুচরা মার্কেটিং-এর স্বর্গ। সঙ্গে আছে হাজার পদের খাবারের অঢেল আয়োজন।
বড়বাজারের কেন্দ্রস্থলে বিখ্যাত নাখোদা মসজিদ। জাকারিয়া স্ট্রিটের কিছুটা হয়ে রবীন্দ্র সরণিতে এসে মিশেছে মসজিদের সীমানা। আর চারপাশে গলি-উপগলিতে একেক জিনিসের ভাণ্ডার। কোথাও শাড়ি, কোথাও প্রসাধনী, কোথাও গরম মশলা, কোথাও হাকিমি-কবিরাজি ঔষধ, কোথাও লোহা-লক্কর, কোথাও ছাতা, ঘড়ি, সাইকেল। কি নেই বড়বাজারে! বলা হয়, হাতি থেকে আলপিন, সবই বড়বাজারে মিশে থাকা নানা সরু সড়কের গলি, তস্য-গলিতে পাওয়া যায়। এই বাজারের চেহারাটা খানিকটা বাংলাদেশের পুরনো ঢাকার মতো। ভিড়, শব্দ, দামাদামি চলছে চারপাশে।
কমদামে ও দ্রুত সেরা দ্রব্যটি হাসিল করতে কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ এমনকি বাংলাদেশ থেকেও নাগরিকরা ছুটে আসেন এখানে। যেকোনো জায়গায় যে চশমার ফ্রেম আড়াই হাজার টাকা আর পাওয়ার বানিয়ে ডেলিভারি দিতে তিন দিন সময় নেয়, বড়বাজারে তা এক তুড়ির ব্যাপার! নিজের চশমা তৈরি করতে হবে তাড়াতাড়ি, হাতে সময় নেই, পরদিন রওনা দেবেন অন্য শহর। চিন্তা নেই বড় বাজার সবসময় খোলা। চশমার ঘাঁটি হলো ক্যানিং স্ট্রিটে। আড়াই হাজারের ফ্রেম দেড় হাজারে রেডি পাওয়ার সহ ডেলিভারি পাওয়া যায় দুই ঘণ্টায়।
শুধু কলকাতা নয়, পুরো ভারতের প্রাচীন ও বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রাচীন ভারতের যাবতীয় ছাপ লেগে আছে বড়বাজারের ক্ষয়ে যাওয়া দালানে, ভাঙা দেওয়ালের মুখ-বের-করা ইটে। সেই ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের সব সম্প্রদায়ের মানুষ, ধর্ম, বর্ণের লোক এখানে ছুটে এসেছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। পর্তুগিজ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাচীন বণিকদের কথা মনে পড়ে যায়। জৈন টেম্পল দেখে রাজস্থানের যোধপুর-মারওয়ার থেকে আগত মারোয়ারি, ঝুনঝুনওয়ালা, আগরওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।। আছে গুজরাতি মেহতা ও প্যাটেলদের বিরাট দালান ও কারবার। শিয়া মুসলিমদের ইমামবাড়াও রয়েছে বড়বাজারে নাখোদা মসজিদের খানিক দক্ষিণ-পশ্চিমে। মুসলিমদের তাবলিগ জামাতের প্রধানকেন্দ্র বড়বাজারের কলুটোলায়। আর হিন্দু মন্দির তো গলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে যেন একটুকরো ভারতবর্ষ এই বড় বাজার। পুরো দেশে আমদানি-রফতানির জন্য সব এলাকার মানুষই এখানে আছেন। আছে তাদের নিজস্ব সমাজ ও ধর্মস্থান। আর আছে সহজ যোগাযোগের জন্য উর্দু ও হিন্দি ভাষার দাপট। বাংলা ভাষাকে বড়বাজারে খুঁজে পেতে কষ্টই হয়।দোকানদার থেকে হোটেল বয়, রিকসাওয়ালা পর্যন্ত উর্দু বা হিন্দিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাহারি খাওয়া-দাওয়ার জন্য বড়বাজার স্বর্গ। রমজানে বড়বাজার এশিয়ার সবচেয়ে বিশাল ইফতারি ও মুঘলাই খানার পসরা সাজিয়ে উন্মোচিত হয়।
বছরের অন্য সময়েও আর কোথাও পাওয়া যাবে না, এমন খাবার বড়বাজারে সুলভে সহজলভ্য। মাহি আকবরি, কোফতা, গ্লাসি আর মুর্গ চেঙ্গিসি’র নামই শুনেনি অনেকেই, তা মিলবে বড়বাজারে। ফিয়ার্স লেন, কলুটোলার দিক থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট—নাখোদা মসজিদের পাড়ায় পদে পদে অপেক্ষমান অজস্র বিস্ময়। এমনিতে এ পা়ড়ার বাতাসে বছরভরই মিশে থাকে সুখাদ্যের সুরভি। তবে রমজানে এ তল্লাট দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানেই ‘ট্রাডিশনাল ফুডওয়াক’। গোটা কলকাতার খাইয়েরাই আসেন বড়বাজারের স্পেশাল মাছ-মুরগির স্বাদ-স্রষ্টাদের কাছে। বছরের অন্য সময় দোকানে বা ফুটপাতে লাগাতার লস্যি, ফালুদা, কফি, কাবাব, রুটি, গোস্ত, পরোটা চলছেই। কেনাকাটার বড়বাজারকে কলকাতার খাদ্য-স্বর্গেও পরিণত করেছে এই ঐতিহাসিক এলাকা।
মাছ-মুরগির শত পদ জাকারিয়ার স্ট্রিটের গৌরব হয়ে পুরো বড়বাজার পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র কলকাতায়। কলকাতা তো বটেই বাংলা এমনকি সংলগ্ন রাজ্যের ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে পাইকারি দরে জিনিস কিনে নিয়ে যান। বহু ছোটো-বড়, নামী-অনামী সংস্থার নিজেদের কাঁচামাল এখান থেকে কেনে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এখানে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। উৎসবের মরশুমে ভিড় আরও বাড়ে। রবিবার এই বাজার বন্ধ থাকে। সমৃদ্ধি এবং আড়ম্বরের দিক থেকে এই বাজারের সমতুল্য আর কোনো বাজার নেই কলকাতায়।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম