পর্দায় তিনি গেয়ে উঠেছিলেন ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’। প্রেমের এমন সাহসী উচ্চারণ আর দ্বিতীয় নেই। ভারতীয় সিনেমা আর প্রেম নিয়ে কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় মধুবালার (Madhubala) কথা। এবং বলতেই হয় তার ‘মুঘল এ আজম’র কথা। এ তো কেবল সিনেমা নয়, বরং প্রেমের মহাকাব্য। আর এই ছবিতে যিনি প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন, তিনি মধুবালা।
দূর্দান্ত অভিনয়, দাপুটে ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্য দিয়ে জিতে নিয়েছিলেন মানুষের মন। হাজারো পুরুষের কাঙ্খিত নারী ছিলেন তিনি। অথচ সেই মধুবালার জীবনে ছিল খালি বেদনা আর বেদনা। নায়িকার জীবনের ট্র্যাজেডি হার মানাবে যে কোনও বলিউড ছবিকে। আয়ু ছিল মাত্র ৩৬ বছর। অথচ এইটুকু কেরিয়ারেই তিনি যা ইতিহাস গড়েছেন তা পারে কয়জন?
তার সৃষ্টি আনারকলি আজও অমর। অথচ এই চরিত্রের জন্য মধুবালার নামটাই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক। অবশ্য তার কারণ ছিলেন মধুবালার বাবা। শোনা যায় তিনি পরিচালকের সামনে এমন কিছু শর্ত রেখেছিলেন যা মানা অসম্ভব ছিল। রেগেমেগে তো সেদিন বলেই দিয়েছিলেন ‘আপনার মেয়েকে শোকেসে তুলে রেখে দিন’। তাহলেই ভাবুন মধুবালার বাবা ঠিক কতটা কঠোর ছিলেন।
এদিকে পরিচালক তখন ভাবলেন নার্গিসের কথা। কিন্তু নার্গিস আবার রাজি নন। তাহলে উপায়? নায়কের ভূমিকায় তখন দিলীপ কুমার ফিক্সড। বিধাতা তো তখনই মুচকি হেসেছিলেন। তিনি তো জানতেন, এই চরিত্রকে কেউ অমর করে রাখতে পারলে তা মধুবালাই।
পরিচালক যখন নায়িকা খুঁজতে গিয়ে হয়রান, ঠিক তখনই হাজির মধুবালা। গাড়ি থেকে নামলেন না। গাড়ির ভিতরই হয়ে গেল এক আশ্চর্য বৈঠক। আর সেই বৈঠকের পরই পরিচালক পেয়ে গেলেন তার আনারকলিকে। ব্যাস, বাকিটা তো ইতিহাস। এখন ভাবলে মনে হয় এই সিনেমা যেন মধুবালা-দিলীপেরই জীবন কাহিনি।
তাদের অসম্পূর্ণ প্রেমের গাঁথা আজও গোটা বলিউডে ছড়িয়ে। দর্শককে যিনি প্রেমের পাঠ পড়িয়েছেন, সেই মধুবালার জীবনেও প্রেম এসেছে বহুবার। তবে ভালো তিনি একজনকেই বেসেছিলেন। তিনি দিলীপ কুমার। বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও বাধা হয়ে ওঠেন নায়িকার বাবা। ওদিকে আবার দিলীপ কুমার শর্ত দিয়ে বসেন হয় পরিবার এবং অভিনয়, নয়তো তিনি।
জানেন, অভিনয়টাও ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন নায়িকা। কিন্তু পরিবারকে ছাড়া কি এতই সহজ? রাগে দুঃখে অভিমানে বিয়ে করে ফেললেন কিশোর কুমারকে। কিন্তু ভালোবাসা কি ভোলা যায়? যাইহোক সংসারটা মন দিয়েই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরই ফের একবার মুচকি হাসলেন বিধাতা। হয়ত দিলীপ কুমারের সাথে তার বিচ্ছেদটা বিধাতার মনঃপুত হয়নি।
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই শয্যাশায়ী হয়ে যান তিনি। জন্ম থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল তাঁর। তবে বিয়ের পর যেন সেটা আরও বেশি করে প্রকট হয়। কিশোর কুমারের সাথে সম্পর্কও তখন তলানিতে। শোনা যায় প্রথমটা অসুস্থ মধুবালাকে নার্সদের দায়িত্বেই রেখে দিয়েছিলেন। পরে নাকি চিকিৎসার বহু চেষ্টা করেছিলেন কিশোর কুমার। তবে শেষরক্ষা আর হয়নি।
শোনা যায় অসুস্থ মধুবালা যখন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি, তখন একবার দিলীপ কুমারকে দেখতে চেয়েছিলেন। খবর মিলতেই ছুটে এসেছিলেন দিলীপ সাহেব। দেখা করে শান্তনাও দিলেন তাঁর প্রিয় মধুকে। সেদিন ঐ হাসপাতালের ঘরেই লেখা হয়ে গেছিল তাঁদের অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনীর ক্লাইম্যাক্স।
এরপর ভাঙা প্রেম, অসুখী দাম্পত্য জীবনের বোঝা নিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া কাটালেন আমাদের মধুবালা।
পর্দার প্রেমের রানি বাস্তবে বারবার আঘাতই পেয়েছেন। তবে ব্যক্তিজীবনকে বাদ দিলে আমরা দেখতে পাই এক অসামান্য শিল্পীকে। যার ম্যাজিক আজ এত বছর পরেও অব্যাহত। চোখ দিয়েই অভিনয় করতেন তিনি। তাঁর চোখের জল দেখে চোখ ভিজেছে কতশত দর্শকের। তাই তো তিনি কেবল অভিনেত্রী নন, মধুবালা হয়ে উঠেছেন এক আইকন। যিনি পুরুষপ্রধান ইন্ডাস্ট্রিতে গড়ে তুলেছিলেন নিজের সাম্রাজ্য।