Iran-Israel Conflict: যুক্তরাষ্ট্রের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাল ইরান, প্রতিশোধ নিল ফিলিস্তিনিদের হয়ে

।। প্রথম কলকাতা ।।

 

Iran-Israel Conflict: যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে, এটা চেনা ছবি। গোটা বিশ্ব জানে। কিন্তু এবার সেই ছকটা পাল্টাতে শুরু করেছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাল ইরান। তেহরান ছেড়ে কথা বলল না যুক্তরাষ্ট্রকেও। পাল্টাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পাশা। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য বারংবার ইরানকে চাপে রাখতে চেয়েছে। একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে তেহরানের উপর। কিন্তু এবার তেহরান সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে চাপাল নিষেধাজ্ঞা। পুরো উল্টো ভূরাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি। দেখছে গোটা বিশ্ব। সাম্প্রতিক সময়ে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে কোনঠাসা হচ্ছে, তাহলে কি এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল ইরান? সুযোগ বুঝে বড় চালটা চেলে দিল। এবার কী করবে যুক্তরাষ্ট্র? তাহলে কি ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত সরাসরি বেঁধেই যাবে? এই দুই দেশের মধ্যে এত শত্রুতার সম্পর্ক কেন জানেন? গোড়ার ইতিহাস জানলে বুঝতে পারবেন, কেন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ইরানের এত রাগ। যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ইরানকে ভয় পেয়ে চলে? কারণটা ঠিক কী? সম্প্রতি তেহরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র পাত্তা পাচ্ছে না কেন? এত সাহস কোথা থেকে পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ?

 

একটা সময় ছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের উপর জোটবদ্ধভাবে নতুন নিষেধাজ্ঞা আনার উদ্যোগ নিত। সেই সময় রাশিয়া হয়তো বা সাপোর্ট করত, কিংবা ইরানের হয়ে দু একটা কথা বলতো। কিন্তু বড় কোন স্টেপ নিতে দেখা যায়নি। এটা বলছি মাত্র কয়েক বছর আগেকার কথা। সাম্প্রতিক সময়ে নিষেধাজ্ঞার ট্রাম্প কার্ডটা যেন একটু বেশি খেলছে মধ্যপ্রাচ্য সহ পশ্চিমা দুনিয়ার দেশগুলো। অথচ কেউ কারোর নিষেধাজ্ঞাকে খুব একটা পরোয়া করে না, পাত্তাও দেয় না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়, একটা দেশ আর একটা দেশের উপর ঠিক কতটা বিরক্ত। একটা দেশ আর একটা দেশের নীতিকে মানছে না। হামাস ইসরায়েলের যুদ্ধের মাঝে গত ১৩ই এপ্রিল ইসরায়েলের উপর প্রথমবারের মতো সরাসরি হামলা করেছিল ইরান। যে হামলায় ইরান সিরিয়া এবং ইয়েমেন থেকে প্রায় ৩০০ টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন নিক্ষেপ করে ইরান। যদিও তার বেশিরভাগটাই ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের দ্বারা ধ্বংস করা হয়। কিন্তু সেই সময় ইসরায়েলে হামলার পর, ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন করে নিষেধাজ্ঞার উদ্যোগ নেয়।

 

এমনকি ঐক্যবদ্ধ কিছু দেশও এই উদ্যোগে নিয়েছিল। ওদিকে ইসরায়েল তার মিত্র দেশের প্রতি তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার অনুরোধ করে। যদিও তেহরানের ক্ষেপনাস্ত্র কর্মসূচির ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার যে মেয়াদ ছিল, তা শেষ হয়েছে গত অক্টোবরে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ সেই আগের নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখে। উপরন্তু যুক্ত করে আরো নতুন কিছু নিষেধাজ্ঞা। যার মূল উদ্দেশ্য, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সীমিত করা। যার প্রতিবাদও করেছে তেহারান। তবে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা খুব একটা দিতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার নিষেধাজ্ঞা চাপাল যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির উপর । প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইরানের উপর থাকা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির সাথে প্রায় সমস্ত আমেরিকান বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হয়ত এতগুলো নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ নিতে তক্কে তক্কে ছিল ইরান। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার অভিযোগে এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞ ঘোষণা করে দিল দেশটা।

 

যেখানে ইরানের পক্ষ থেকে ঘোষণা স্পষ্ট বলা হয়েছে এদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক পদক্ষেপ ব্যবস্থা হিসেবেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাত নাগরিক। যাদের মধ্যে অত্যন্ত বিশেষ ব্যক্তি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশনস কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ব্রায়ান পি ফেন্টন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের সাবেক কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপার। অপরদিকে যুক্তরাজ্যের যে সমস্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তেহরান নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস, ব্রিটিশ আর্মি স্ট্রাটেজিক কমান্ডের কমান্ডার জেমস হকেনহাল। প্রতিষ্ঠান হিসেবে তেহরানের নিষেধাজ্ঞার কবলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন আর শেভরন। অপরদিকে যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে পার্কার মেগিট, এলবেইট সিস্টেমস এবং রাফায়েল ইউকে। শুধু তাই নয়, লোহিত সাগরে থাকা যুক্তরাজ্যের নৌ বাহিনীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তেহেরান।

 

বুঝতে পারছেন, দেখে দেখে গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিদের উপরেই নিষেধাজ্ঞা চাপালো ইরান। যেন প্রতিশোধের অপেক্ষা করছিল দেশটা। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে কিন্তু বড়সড় লস খেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য। এর ফলে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ওই প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা ইরানের আর্থিক আর ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন করতে পারবে না। ইরানে থাকা তাদের সমস্ত সম্পত্তির উপর একইভাবে নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে। এই ব্যক্তিগণ কিংবা প্রতিষ্ঠান কখনোই ইরানের কোন অঞ্চলে আর প্রবেশ করতে পারবে মা। যদিও এর ফলে ইরানের সঙ্গে থাকা তাদের চুক্তি কিংবা ইরানে থাকা তাদের সম্পদে ঠিক কতটা প্রভাব পড়তে চলেছে সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

 

সোজা কথায়, ইরানের এহন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল যে, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে ইরানের অ্যাকশন শুরু। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে ইরানকে সরাসরি কোন অ্যাকশন নিতে দেখা যায়নি। এবার হয়ত দেশটা পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে দিয়েছে। অভিযোগ, গাজায় হামলা চলছে, আর তাতে নাকি মদদ দিচ্ছে এই দুটো দেশ। যুদ্ধের শুরু থেকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রয়েছে উপসাগরীয় দেশ ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ বলছে, ইসরায়েলে হামাস যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিল, সেই হামলার নেপথ্যে রয়েছে নাকি ইরান। এই দেশটার অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ পেয়ে হামাস ইসরায়েলে এমন হামলা চালানোর সাহস পেয়েছে। আর সেই সমস্ত হামাসকে নির্মূলের নামে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তেল আবিব।

 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কূটনৈতিক ভাবে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অপমান করতেই ইরানের এমন চতুর কৌশল। যার আড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটা নিষেধাজ্ঞা নামক অস্ত্রকে হাস্যকর জিনিসের রূপান্তর করতে চাইছে। যদি সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকান, তাহলে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, এই নিষেধাজ্ঞা দিনের পর দিন যেন একটা কমদামি অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কোনো দেশ শত্রুপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করে সেই দেশের নীতিকে অস্বীকার করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বিপরীত পক্ষ মানল কি মানলো না, সেসব গুরুত্বই পাচ্ছে না। একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মানে ছিল একটা বড় কিছু ব্যাপার। বিশ্বের বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে রীতিমত ভয় পেত। আবার কেউবা সম্মান করত। এমনকি নিষেধাজ্ঞার ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী কাজ করতেও বাধ্য হয়েছে বহু দেশ। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, নিষেধাজ্ঞাকে যেন আর ভয় পাচ্ছেনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।

 

দেখুন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের বৈরিতার ইতিহাস কিন্তু আজকের নতুন নয়। ১৯৫০ এর দশক থেকে এই দুই দেশের সম্পর্ক দিনের পর দিন অবনতি পথে। সংঘাত হচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের। আর সেখানে দলাদলি করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশ নিয়েছে দুই পক্ষ। তবে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই তিক্ত যে, ভবিষ্যতে এরা একে অপরের সাথেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইরানের যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সাল নাগাদ। সেই সময় ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদেক চেয়েছিলেন তেল সম্পদকে সরকারিকরণ করতে। যার অধিকাংশটাই ছিল ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ইরানিরা খুব একটা সুবিধা পেত না। তারপর হঠাৎ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাকচ্যুত হন তৎকালীন ইরানের প্রধানমন্ত্রী। তারপরেই গুঞ্জন উঠে, এই অভ্যুত্থানের পিছনে নাকি রয়েছে মার্কিন আর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাত। বিষয়টাকে আরো উসকে দেয়া হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে মোহাম্মদ রেজা শাহ ইরানের ক্ষমতায় আসেন। তখন তার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন ইসলামপন্থী নেতা আয়াতুল্লাহু খামেনি।

 

৭০ দশকের দিকে ধীরে ধীরে ইরানের জনগণের একটা বড় অংশ রেজা শাহের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারপর ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানের সুপ্রিম লিডার হয়ে ওঠেন খামেনি। সেই সময় ইরানের নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্রে আরো গাঢ় হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব। ওই বছরই খামেনি পন্থী বহু ছাত্র প্রবেশ করে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে। প্রায় ৪০০ দিনেরও বেশি জিম্মি করে রাখে ৫২ জন আমেরিকানকে।এই ঘটনার পরেই যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের জন্য ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়ে ওঠে ১৯৮০ সালে, ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে। যেখানে ইরাককে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০০০ সাল নাগাদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উপর নজর রাখতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, বাড়াতে থাকে আন্তর্জাতিক চাপ। যার কারণে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় ইরানের তেল রপ্তানি এবং অর্থনীতি।

 

২০১৫ সাল নাগাদ ইরান তাদের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে সম্মতি হয়েছিল, কিন্তু শর্ত ছিল ইরানের উপর থাকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। কিন্তু ২০১৮ সাল নাগাদ সেই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উপরন্তু বলেন, পরমাণু কর্মসূচি কমিয়ে আনতে হবে এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত ও কর্মসূচি স্থগিত করতে ইরানকে আরেকটি নতুন চুক্তি করতে হবে। কিন্তু ইরান ট্রাম্পের সেই সিদ্ধান্ত মানেনি। তারপর থেকে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বাড়তেই থেকেছে। আর এখন তো সম্পর্ক পৌঁছেছে একদম খাদের কিনারে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, ভবিষ্যতে যদি ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, সেটা গোটা বিশ্বের কাছে নতুন কোন ঘটনা হবে না।

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version