Iran-China-Us: ইরান-চীনের তেল ব্যবসায় দারুণ ফন্দি, বোকা বনে গেল যুক্তরাষ্ট্র!

।। প্রথম কলকাতা ।।

 

Iran-China-Us: মধ্যপ্রাচ্যকে কব্জা করতে চাইছে চীন। প্রথম টার্গেট তাই ইরান। ইরান-চীনের বন্ধুত্ব দেখেও কিচ্ছু করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। তেহরান আর বেজিংয়ের মাঝে ম্যাজিক ফিগার হয়ে দাঁড়িয়েছে তেল অর্থনীতি। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, এমন স্ট্যাটিজিতে দুই দেশ বাণিজ্য করছে, জানলে হতবাক হবেন। বোকা বনে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন-ইরানের ফন্দি ধরেও যেন ধরতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যে তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যাবে চীন? ইরানের পাশে চীন আছে বলেই, স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছে তেহরান।

 

গোটা মধ্যপ্রাচ্য যখন উত্তপ্ত, ইরানের সাথে বাণিজ্যের যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে তোয়াক্কা না করে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন তেল কিনছে ইরান থেকে। ইরানের তেলের উপর হাজারো নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, তার কোন এফেক্টই পড়েনি তেহরানের উপর। অথচ এই তেলের উপর নির্ভর করে আছে দেশটার অর্থনীতি। কোন সিক্রেটে তেহরান নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে? কূটনৈতিক মহল বলছে, এর অন্যতম কারণ চীন। শি জিনপিং যদি শক্ত হাতে ইরানের পাশে না থাকতেন, তাহলে ইরান কোনভাবেই নিষেধাজ্ঞা পাহাড় মোকাবিলা করতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রকে জব্দ করতে আর মধ্যপ্রাচ্যে নিজের জায়গা পাকা করতে, চীনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইরান। ওদিকে ইরানও নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থে নিজের মাটিতে বেইজিং এর জন্য বেশি সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে।

 

এইতো, গত এপ্রিল মাসে, ইরান যখন ইসরাইয়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ৩০০ এর বেশি মিসাইল আর ড্রোন হামলা চালায়, তখন কিন্তু দেশটার তেল রপ্তানির উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর আগেও একাধিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ছিল তেহরান। কিন্তু ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ শুনলে একটু অবাক হতে হয়। ২০২৪ সালে ৪ মাসে তেহরান তেল রপ্তানি করেছে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায়। যার পরিমাণ নয় নয় করে প্রায় ৩৫.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তাহলে বুঝতে পারছেন, ইরানে তেল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞার কোন এফেক্ট পড়েনি। বরং সুচারুভাবে এড়িয়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লগিরি। মনে করা হচ্ছে, চীন যদি ইরানের পাশে না থাকত তাহলে এই কাজ এতটা সহজসাধ্য হত না। মুখ থুবড়ে পড়ত ইরানের তেল ভিত্তিক অর্থনীতি। যার পুরো সিক্রেটটাই লুকিয়ে রয়েছে চীনের বাণিজ্যিক কৌশলের উপর। ইরান বিশ্বে যত পরিমান তেল রপ্তানি করে তার ৮০ শতাংশই শুধু যায় চীনে। প্রতিদিন ইরান প্রায় দেড় মিলিয়ন ব্যারেল তেল চীনে রপ্তানি করে থাকে। এখানে বেজিংয়েরও স্বার্থ কম নেই । ভূ রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির কথায় পড়ে আসছি।

 

যেহেতু ইরানের তেল মানে ভালো ,আর দামের সস্তা। তাই ইরানের তেলের চাহিদাও বেশি। ওদিকে বেইজিং আর তেহরানের সম্পর্ক অত্যন্ত গাঢ়। তাই চীনের কাছে তেল কেনার ক্ষেত্রে ফার্স্ট অপশন এখন ইরান। ইরানের সাথে বাণিজ্যের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সেসব দিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেন না শি জিনপিং। তার উপর আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের কারণে যখন গোটা বিশ্বে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক সেই সময় ইরান তার তেল বিক্রি করতে মরিয়া। বরং অন্যদের তুলনায় একটু কম দামেই তেল বিক্রি করে। হিসাব করলে, ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে ইরান, রাশিয়া আর ভেনেজুয়েলা থেকে থেকে তেল কিনে চীন অন্তত লাভ করেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সাধারণত বৈশ্বিক মানদণ্ডে, অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের নিচে থাকে। কিন্তু ইরান তাদের তেল ব্যারেল প্রতি বিক্রি করে তার থেকে অন্তত পাঁচ ডলার কমে। শুধু তাই নয়, গত বছর এই দাম সর্বোচ্চ কমিয়েছিল। আসলে পুরোটাই ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। তাই তো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের মতে, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তলে তলে যে বিরোধের খেলা চলছে তারই একটা অংশ হয়ে উঠেছে ইরান।

 

একদিকে বেজিং তেহরানের অর্থনীতিতে সাহায্য করছে, অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাকা করছেন নিজের জায়গা। আর এর মাধ্যমেই ভূরাজনৈতিক এবং সামরিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে ওয়াশিংটনের দিকে। ইসরায়েল আর ইরানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মাঝে, এমন পদক্ষেপ কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বহু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছে, বিগত কয়েক বছর ধরেই চীন আর ইরান এই নিষিদ্ধ তেল আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা সূক্ষ্ম পদ্ধতি অনুসরণ করছে। যেখানে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ছোট স্বাধীন রিফাইনারিজ, চীনের আঞ্চলিক ব্যাংক আর ডার্ক ফ্লিট ট্যাঙ্কারস। মূলত আন্তর্জাতিক ভাবেই যাদের পরিচিতি অত্যন্ত নগণ্য। এই সমস্ত জায়গার মাধ্যমে লেনদেন করলে কিংবা ইরানের তেল পরিশোধন করা হলে নানান সুবিধা থাকে। ঝুঁকিও বেশ কম।

 

আরে একটু আগে যে বললাম, ডার্ক ফ্লিটের কথা, এটা মূলত একটা অস্পষ্ট মালিকানা ধরনের ট্যাঙ্কারস নেটওয়ার্ক। বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তেলের ট্যাঙ্কার গুলো সমুদ্রে ট্র্যাক করা হয়ে থাকে। তার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন সফটওয়্যার। ট্র্যাকিং এড়ানোর জন্যই ইরান আর চীন ব্যবহার করে এই ধরনের অস্পষ্ট মালিকানার নেটওয়ার্ক। যার ফলে তারা খুব সহজেই এড়িয়ে যায় সিপিং চার্জ। ধুলো দিতে পারে পশ্চিমাদের চোখে। নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তেই হয় না। অপরদিকে পশ্চিমাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক লেনদেন পদ্ধতির ক্ষেত্রে চীন আর ইরান ব্যবহার করে ক্ষুদ্র চাইনিজ কিছু ব্যাংক। কারণ যেহেতু ইরানের তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে যদি চীন তেল কেনে তাহলে তো ঝুঁকি থাকবেই। বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকে লেনদেন করলে ফেঁসে যেতে পারে বেজিং। তাই যেসব এমন সব ব্যাংক ব্যবহার করে, যাদের আন্তর্জাতিক কোন পরিচিতি নেই। শুধু তাই নয়, ইরানের তেলের জন্য চীন ডলারই নয়, অর্থ পরিশোধ করে চাইনিজ মুদ্রায়।

 

বর্তমানে পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলো সংগঠন ওপেকে ইরান তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ। প্রতিদিন প্রায় তিন মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপন্ন করে। যা সারা পৃথিবীর তেলের প্রায় ৩ শতাংশ। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, ইরানের তেল উৎপাদন কিংবা পরিবহনে যদি কোন রকম বড়সড় ধাক্কা লাগে, তাহলে কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম বেড়ে যাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। হয়ত বা জো বাইডেনও জানেন, ইরানের তেল রপ্তানি হঠাৎ করে কমে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে তেলের দাম। আর তার এফেক্ট পড়বে যুক্তরাষ্ট্রেও। তাই হয়তো চীন আর ইরান কোন পথে তেলের লেনদেন করছে বা ব্যবসায়িক পদ্ধতি জারি রেখেছে, সেই দিকে ইচ্ছাকৃত কড়া নজর রাখছে না ওয়াশিংটন। এমনটাই ধারণা কূটনৈতিক মহলের।

 

আর তাই হয়তো, এত সহজেই ওয়াশিংটনকে ফাঁকি দিতে পারে বেজিং। গত বছরের রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কিন্তু তেলের উৎপাদন বাড়ছে ইরানে। পাশাপাশি বাড়ছে তেল বিক্রির পরিমাণ। গত বছর চীনের জ্বালানি তেল কেনার পরিমান পৌঁছেছে রেকর্ড পর্যায়ে। ইরানের তেল ব্যবসায় লাগাম টানতে, বিশ্বের যেসব বন্দর এবং পরিশোধনাগারে ইরানের তেল প্রক্রিয়াজাত করে তাদের ব্যবস্থা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন আইন প্রণয়নেরও চিন্তা করতে থাকে ওয়াশিংটন। আর এইসবের মাঝে ২০২৩ এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর, পর্যন্ত চীন ইরানের থেকে দৈনিক গড়ে তেল আমদানি করেছে প্রায় ১০ লক্ষ ৫ হাজার ব্যারেল।

 

এখন চীন হল ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। ২০১৭ সালে ইরানের উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসার আগের সময়ের থেকে চীন এখন আমদানি করে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের পর চীন ইরানের থেকে তেল কেনেনি বলে কাগজপত্র দেখায়। আসলে কি বলুন তো, ইরানের যত তেল চীনে আসে তার সবটাই মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে বলে দাবি করে বেজিং। যার মূলে রয়েছে, সেই নাম গোত্রহীন ডার্ক ফ্লিট। ২০২১ সালের পর ইরানের পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ১৮০ টি প্রতিষ্ঠান আর ৪০টি জাহাজের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তেহরান আর বেজিংয়ের মধ্যে তেল রপ্তানি কিংবা আমদানিতে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি।

 

আসলে তেহরানের সাথে সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে, বেজিংয়ের মূল নজর গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। বছর তিনেক আগে, চীন আর ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে একটি চুক্তি। যে চুক্তির মাধ্যমে আগামী ২৫ বছর দু দেশের মধ্যে বজায় থাকবে কৌশলগত অংশীদারিত্ব। মূলত এটি চীনের সুবিস্তৃত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ কর্মসূচিতে সর্বশেষ সংযোজন। বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া চীন। আর সেখানে একটা শক্ত খুঁটি হিসেবে কাজ করছে ইরান। ইরান কিন্তু চীনের থেকে চীনের তুলনায় ছোট একটা দেশ। কিন্তু বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এছাড়াও দেশটার এছাড়াও ইরানের প্রতিবাদী বৈদেশিক নীতির কারণে আলাদা একটা স্বকীয়তা রয়েছে। যা বেজিংয়ের পছন্দের অন্যতম কারণ। চীন নিজেকে একবিংশ শতাব্দী আর পরবর্তী বিশ্বের একটা উদীয়মান শক্তি হিসেবে মনে করে। বিশ্বাস করে, হয়ত একদিন দীর্ঘমেয়াদি যুক্তরাষ্ট্রের পতন হবে। আর সেই জায়গায় রাজ করবে চীন।

 

এমত পরিস্থিতিতে, যে শক্তিধর রাষ্ট্র আসুক না কেন, সেই রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনা। আর এই সহজ ইকুয়েশনটাই বুঝে গিয়েছে বেজিং। ইরানের মাধ্যমে উপসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা নিতে চাইছে দেশটা। এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে ফিলিস্তিন- ইসরায়েল সম্পর্ক, ইরানের পরমাণু চুক্তি এবং এই এলাকায় সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চীন পিপলস লিবারেশন আর্মির মাধ্যমে লোহিত সাগরের প্রথম বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি গড়েও তুলেছে, যেটি পড়েছে জিবুতিতে। উপসাগরীয় অঞ্চলকে নিজের হ্রদ বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। বেইজিং সেখানেই যেন আঁকতে চায় নিজের নৌবাহিনীর পদচিহ্ন। যার সঙ্গ দিচ্ছে ইরান।

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version