বাংলাদেশে ফাটানো হয় কামান, ভারতে তীব্র শব্দ এলে মায়ের আবাহন শুরু হয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য

।। প্রথম কলকাতা ।।

কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশে ফাটানো হয় কামানের গোলা। সেই তীব্র শব্দ এসে পৌঁছায় ভারতে। কানে আসতেই উল্লাসে মেতে উঠে গোটা গ্রাম। শুরু হয় দেবীর আবাহন। এখানে মা ভীষণ জাগ্রত। সময় পেরোলেও ঘুণ ধরেনি ঐতিহ্যে, তবে বদল এসেছে নিয়মে। চিরাচরিত সেই প্রথা আজ শুধুই ইতিহাস। নেই রাজা, নেই রাজ্যপাটও। শুধু থেকে গেছে কাঁটা তারের বেড়া। ভারতের পুজোর সঙ্গে কেন গভীরভাবে জড়িয়ে বাংলাদেশের পুজো? এপারে পুজো হলে কেন মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের কথা? কারণটা কি?

আজ এমন এক ঐতিহ্যময় পুজোর গল্প শুনবেন যার কথা মনে রেখেছে ভারত বাংলাদেশের মানুষ। ইতিহাস ভোলার নয়, ঐতিহ্য মুছে যাওয়ারও নয়। আগে ওপার বাংলার কামানের শব্দে সূচনা হত এপার বাংলার এক পুজো। স্বাধীনতার সেই আগে থেকেই সীমান্তবর্তী রাধিকাপুরের উদগ্রামের এই পুজো দুই বাংলার মানুষের কাছে জনপ্রিয়। বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুরের রাজবাড়িতে কামানের গোলা ফাটিয়ে দুর্গা পুজোর সূচনা হত। আর সেই কামানের গগনভেদী শব্দ এসে পৌঁছাত এপার বাংলার উত্তর দিনাজপুরের মাটিতে। আওয়াজ শুনে রাধিকাপুরে শুরু হত দেবীর আরাধনা।

একদম কাঁটা তার ঘেঁষে রয়েছে গ্রামটা। একটু উঁচু জায়গায় অবস্থিত হলে লোকে বলে উদগাঁও। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এখানে দেবী দুর্গাকে পুজো করা হয় চন্ডী রূপে। গ্রামের মাঝখানে এক সময় ছিল টিনের দালানের চন্ডীমণ্ডপ। এখন বদলে করা হয়েছে পাকা দালান। শোনা যায়, পুজোর জন্য জমি দান করেছিলেন তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজারা। শুধু তাই নয়, গ্রামের বহু নিঃসন্তান পিতা মাতা পুজোর জন্য জমি দিয়েছিলেন। দুর্গা পুজোর নামে ছিল প্রায় ১২ বিঘে জমি। কিন্তু দুঃখের কথা, দেশভাগে সেই জমিও ভাগ হয়ে যায়। এখন মোটে পড়ে আছে পাঁচ থেকে ছয় বিঘা জমি। বাকিটা চলে গিয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে। সারা বছর জমির ফসল থেকে যে টাকা আসে, তা দিয়েই চলে মন্দিরের খরচ সহ মায়ের পুজো। আলাদা করে কোন চাঁদা তোলা হয় না।

রাজা, রাজ্যপাট না থাকলেও রয়ে গিয়েছে পুজো। দেশভাগের বিভাজন কিন্তু উদগ্রামের পুজোয় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনি। প্রতিবছর নিষ্ঠা ভরে গ্রামবাসীরা মৃন্ময়ী প্রতিমার পুজো করেন। কোন খামতি নেই উন্মাদনায়। সেই কামান দাগার আওয়াজ নেই, কিন্তু রয়েছে পুরনো প্রথা। খুঁটিনাটি মেনে দশভূজার ঘট বসানো হয়। পুজোর চারটে দিন গোটা গ্রাম জুড়ে কেউ আমিষ ছোঁন না। চলে নিরামিষ ভোজন। বিভিন্ন কাজে যারা গ্রামের বাইরে থাকেন, পুজোর দিনগুলোতে ফিরে আসা চাই। বলা হয়, উদগ্রামের মা ভীষণ জাগ্রত। বিয়ে অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে সমস্ত শুভ কাজের আগে পুজো দেওয়া হয় মায়ের মন্দিরে। মায়ের কাছে মানত করলে বিফলে যায় না মনস্কামনা।

দেখুন, যদি দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ আসে তাহলে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসবেই। যেখানে বাঙালি সেখানেই দুর্গাপুজো। দেশভাগের আগে সবই তো ছিল এক। উলটপালট করে দিয়েছে সামান্য কাঁটাতার। কিন্তু কমেনি নাড়ির টান। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে এপারে চলে এসেছিল বহু বনেদি পরিবার। সেই পুজো ইতিহাসের কথা বলতেই চলে আসে বাংলাদেশের কথা। এখনো পর্যন্ত আলিপুরদুয়ারের চৌধুরী বাড়ির পুজোর মাটি আসে সেই বাংলাদেশ থেকে। পরম্পরার পাশাপাশি মিশে রয়েছে আত্মিক টান। দেশভাগের যন্ত্রণা থাকলেও পুজোর আনন্দ মাটি হয় না। এখানে প্রতিমা তৈরি হয় ময়মনসিংহ জেলার চৌধুরীদের ভিটের মাটি দিয়ে। সেই প্রতিমার পুজো হয় এপার বাংলার আলিপুরদুয়ারের কাঁঠাল তলার বাড়িতে। একটু ঢুঁ দিলেই ভারতজুড়ে পাবেন এমন অজস্র উদাহরণ।

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version