।। প্রথম কলকাতা ।।
Bangladesh: বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমার সম্পদ কার ? এই নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে কম বিতর্ক ছিল না। ধিকি ধিকি বাড়তে থাকা বিতর্কের আগুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলাদেশ আর মিয়ানমারকে। সমুদ্রে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশের যুদ্ধ জাহাজ। আজ থেকে ঠিক ১০-১২ বছর আগে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দুটি দেশই ছিল পিছিয়ে পড়া দেশের তালিকায়। সেই সময় দুই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে টানাপোড়েন ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০০৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল ” বাংলাদেশ ও বার্মা বিশ্বের দরিদ্রতম দুটি দেশ বিতর্কিত গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে” । শুধু ব্রিটিশ গণমাধ্যম নয়, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বের তাবড় তাবড় গণমাধ্যমে এটি ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের একটি হট টপিক। তখন সমুদ্রসীমার চিত্র ছিল একেবারে আলাদা, মিয়ানমার কিংবা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই তখন সমুদ্রসীমার সম্পদ নিয়ে তিন দেশের মধ্যেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই সময় বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে দরিদ্র দেশ হিসেবে দেখা হত। দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সম্পদের টানাপোড়েন লেগেই থাকত। এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বহু বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা মহলে বঙ্গোপসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে গ্যাস এবং তেলের ভাণ্ডার নিয়ে আলোচনা চলছিল। স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রসীমা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছিল ভারত এবং কোরিয়ার। কারণ দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে তেল কিংবা গ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
সেই সময় বাংলাদেশেও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে নানান টানমাটাল চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তখন বেশ জটিল। বিদেশি কোম্পানিকে সরকারের গ্যাস ক্ষেত্র তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩১ শে অক্টোবর তৈরি হয় মানববন্ধন। তখন কিন্তু গ্যাসক্ষেত্র গুলি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। মিয়ানমার সমুদ্র সীমার যে অংশে গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছিল সেই অংশটি প্রকৃতপক্ষে কোন দেশের, তার নির্দিষ্ট কোন সীমা ছিল না।
সেই সময় মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু। গ্যাসের সন্ধানে এই কোম্পানি প্রায় চারটি জাহাজ নিয়ে সমুদ্র বক্ষে নেমে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হল, তাদের পাহারা দিতে মিয়ানমার নিযুক্ত করেছিল নৌ বাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ। প্রশ্ন এখানেই। গ্যাস আহরণের ক্ষেত্রে কেন মিয়ানমারকে দুটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়োগ করতে হয়েছিল? তাহলে কি মিয়ানমার আগেভাগেই আঁচ করেছিল তারা বিতর্কিত জায়গায় গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে, আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাধা দিতে পারে! তাদের অনুমানও সত্যি হয়। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের ১ তারিখ দিন ছিল শনিবার। বাংলাদেশও মিয়ানমারকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। বাংলাদেশের চারটি জাহাজ চলে যায় সেই গ্যাস অনুসন্ধানের জায়গায়। প্রথমে যায় বিএনএস নির্ভয় , বিএনএস আবুবকর এবং বিএনএস মধুমতি। তারপর এদের সঙ্গে যোগ দেয় বিএনএস কপোতাক্ষ নামক আরেকটি ফ্রিগেট জাহাজ। নৌ বাহিনী ১ তারিখের সকালের দিকে বাংলাদেশের সীমানায় ওই চারটি জাহাজ দেখতে পেলে তাদের ফিরে যেতে বলে। তার যার মধ্যে তিনটি জাহাজ বেলা বারোটার দিকে ফিরে গেলেও বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আবার জাহাজগুলি ওই জায়গায় চলে আসে।
ঘটনাটি ঘটেছিল সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। বিরোধপূর্ণ এই এলাকা মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়ে নিজেদের বলে দাবি করেছিল। সেদিন মুখোমুখি দুই দেশের জাহাজ থাকলেও যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু সমস্যার সমাধানের পথ সহজ ছিল না। নৌবাহিনী দ্রুত বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়। তখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদে জানানো হয়েছিল। জানলে আশ্চর্য হবেন, সেই সময় দাঁড়িয়ে দুই দেশের সম্পর্ক একেবারেই খারাপ ছিল না। কারণ এই ঘটনার মাত্র এক মাস আগে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রায় ৫৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।
তবে যুদ্ধ বাঁধতে গিয়েও যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল বাংলাদেশে থাকা কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের কারণে। তৎকালীন সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবের পুরনো বন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত। অপরদিকে মিয়ানমারের যে কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছিল সেই কোম্পানি ছিল কোরিয়ার অর্থাৎ যদি গোলাগুলি হয় তাহলে মারা পড়বে কোরিয়ার মানুষ। তৎকালীন বাংলাদেশের কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখেন। কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু অমীমাংসিত সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা বাতিল করে জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। প্রায় ৯ দিন মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের জাহাজগুলি মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। সেই সময় সীমান্ত ছিল একদম থমথমে। ২০০৮ সালের সেই সমস্যা সমাধানে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। অবশেষে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে এই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে।
ইটলাসের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। বিরোধ মেটার পর বাংলাদেশ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটোরিয়াল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সুনির্দিষ্ট করা হয়। হিসাব অনুযায়ী সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে প্রায় ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রের তলদেশের প্রাণিজ এবং অপ্রাণিজ সম্পদের অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম