।। মীর আব্দুল আলীম ।।
Dhaka Fire News: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বেইলি রোড। খাবারদাবার, শপিং আর সুন্দর সময় কাটানোর স্থান। নামীদামী রেস্টুরেন্ট, বড় বড় শপিং সেন্টারে সমারোহ এই বেইলি রোডে। দিবারাত্র প্রাণচঞ্চল। সেই জায়গায় এক ভবনে ঘটেছে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫ জন। আহত হয়েছেন অনেকে। আনন্দের সময় কাটানোর জায়গাটা এতটা ভয়াবহ হবে কেউ ভবেনি কখনো। ভবনে আগুন লাগতেই পরে, এমন ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা থাকবে না এটা কি ভাবা যায়? খোদ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। এ দায় কে নেবে? ভবন মালিক? ভবনটিতে যারা ব্যবসা করছেন তারা? নাকি সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িতে আছেন সেসব বিভাগ? এমন ঘটনাতো সবসময়ই ঘছে এদেশে। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু কারোর উপর দায় চাপে না। তাই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের অগ্নিকুন্ডলিতেই বসবাস করতে হয়। লাশ হতে হয়!
রাজধানী ঢাকায় ভবন নির্মাণে আইন মানা হয় না, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকে না। থাকে না বিকল্প সিঁড়িও। আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব আছে। সবখানেই সমস্যা! তাহলে বাঁচার উপায় কি? আগে অসভ্যতার আগুন নেভাতে হবে। অসভ্যতার আগুন নেভায় সাধ্য কার? সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হতেই হবে নইলে ফি বছর আমরা এভাবে আগুনে পোড়া লাশ দেখতেই থাকবো। ২৯ ফেব্রুয়ারী বেইলি রোডের ব যে বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে সেখানে অগ্নিনির্বাপণের তেন কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না বিকল্প সিঁড়িও। তাহলে মানুষ পুড়ে অঙ্গার তো হবেই। সবখানেই অসভ্যতার ছোঁয়া তাহলে আগুনে পুঁড়ে মানুষতো মরবেই!
আমাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১ নবাবকাটরায় পাঁচতলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হারাতে হয় ১২৩ জনকে। আহত হয় কয়েকশ মানুষ। এর পর গত ২৩ বছরে বহু অগ্লিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এক দশকে পুরান ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১৪৯৩ জন। তবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০১১ সালে ৩৬৫ জন। এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। তারপরেও প্লাস্টিক ও কেমিক্যালের কারখানায় চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরান ঢাকার মানুষ।
২০১৯’এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে ফের আগুন লাগে। ফাগুনের আগুনে শতাধিক মানুষ পুড়ে ছাই হয়। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর চকবাজার এলাকা। ক্যামিক্যালের গোডাউনে ঠাসা পুরো এলাকা। আগুন লাগলে তো মানুষ মরবেই। আগুনে মানুষ মরে কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের টনক নড়ে না। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় অনেক পরিবারকে। মূলত কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনেই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সম্পদের সঙ্গে মানুষও আঙ্গার হয়। ক্যামিক্যাল গোডাউন ঘনবসতীপূর্ণ এলাকায় যেখানে সেখানে হলে মানুষতো পুড়ে মরবেই। এতো প্রাণ যাবার পরও প্রশ্ন হলো রাজধানীর ঘনবসতীপূণ এলাকা থেকে কি ক্যামিক্যাল গোডাউন সরানো হয়েছে আদৌ! সেদিন বনশ্রীর ডি ব্লকের এক বাসিন্দা লিখেছেন- রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচুড়া কন্ডেমিনিয়ামে বসবাস করেন ৯০টি পরিবারে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ। ঠিক এর মুল ফটকে আছে ক্যামিকেল গোডাউন। তারা বারবার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানালেও ক্যামিকেল গোডানটি আছে বহাল তবিয়তে। এমন অসংখ্য ক্যামিকেল গোডাউন রয়েছে পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক ভবনে। প্রতি বছর আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সেখানে রয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের পয়সা দিয়ে যথাস্থানেই। তাহলে তো মানুষ মরবেই। কোনোভাবেই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না পুরান ঢাকাবাসীর। অহরহ ঘটছে প্রাণঘাতী আগুন।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো সরনোর কথা। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশ ছিল। কে সরাবেন? কে শোনে কার কথা? যারা ক্যামিক্যাল গোডাউনগুলো সরানোর কাজ করবেন তারা তো বিলাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই যা হবার তাই হয়। এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে এতো উদাসীনতা কেন? বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ মানুষের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিলেও তার কেন প্রয়োগ নেই ভবনগুলোতে। ঢাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কায় থাকে নগরবাসী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে। সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সব ভবন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে।
অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস। যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। তারা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল। যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। যতদূর জানি, ঢাকার মানুষের জন্য প্রথম সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করে ঢাকার নবাব পবিবার। তখন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেই ফায়ার হাইড্রেন্টে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার না হলেও সাধারণ মানুষ গোসল খাওয়া দাওয়াসহ বিভিন্ন কাজেই সেই ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে এসব পানির উৎস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এগুলো আজ চালু থাকলে প্রয়োজনীয় পানি পেতে বেগ পেতে হতো না। শুধু ফায়ার হাইড্রেন্ট নয়, ঢাকায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে পুকুর ডোবাসহ নানা ধরনের জলায়শও ছিল। এসব থেকে অগ্নি দুর্ঘটনারোধে সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে এগুলো ভরাট, দখল হয়ে গেছে। আজ উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্মুক্ত এসব জলাশয় বন্ধ করে দেয়ার কারণে আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে বা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। দূর থেকে গাড়ি ভরে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও। সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ না করে তৈরি হওয়া ভবনগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে! ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ভবন মালিকদের নোটিশ দিলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না ভবন মালিকরা। এমনকি নোটিশের জবাবও দেন না। ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে নিয়ম না মানা এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা না মানার ফলে বারবার মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বছরে কয়েকশ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অগ্নিকাণ্ডে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে লোকজন সাধারণত বোঝে ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বহুতল ভবনে আগুন নির্বাপণ ও জরুরি নির্গমনে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা জরুরি। এগুলো হলো-রাইজার স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় স্প্রিং কলার, আন্ডারগ্রাউন্ড পানির রিজার্ভ, ফায়ার ফাইটিং পাম্প হাউজ, স্মোক ও হিট ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার লিফট নির্মাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমাদের অল্প কিছু ভবনেই এ নিয়ম মানা হয়। ফলে নিয়মিত বিরতিতেই অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও এ আইন প্রয়োগের নিয়ম আছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে এসব আইনের প্রয়োগ নেই।।নামমাত্র অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়েই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অনিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে নিয়ম না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর নির্বাপণ ব্যবস্থা ও ভবন থেকে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা আরও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
(প্রতিবেদনের মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব )
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ