Iran-Saudi Arabia: ইরানের ঘোর শত্রু সৌদি আরব, দায়ী কী ইসরায়েল?

।। প্রথম কলকাতা ।।

 

Iran-Saudi Arabia: সৌদি আরব আর ইরান, একে অপরকে যেন সহ্য করতে পারে না। চীনের মধ্যস্থতা ক্ষতের মলম লাগলেও, দুই দেশ আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য মাঝেমধ্যেই নেমে পরে তীব্র লড়াইয়ে। প্রায় কয়েক দশক কেটে গিয়েছে, কিন্তু দুই দেশের শত্রুতা কমেনি। সাম্প্রতিক সময় ইসরায়েল আর হামাস দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে, ইরানের সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়েছে ইসরায়েল। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ ইরানের হয়ে কথা বলছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সৌদি আরব কিন্তু একদম চুপ। এমনকি ইসরায়েল বিরোধী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করছে সৌদি আরব। ব্যাপারটা কি? এত শত্রুতাই বা কেন? দুই দেশের শত্রুতা নাড়িয়ে দিতে পারে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভিত। চীনের পলিসি কি তাহলে এখানে গিয়ে ফেল করল? ইসরায়েল এই শত্রুতা উসকে দিচ্ছে না তো?

 

বর্তমানে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিন ইস্যুতে, সৌদি আরব বেশ বিতর্কিত জায়গায় দাঁড়িয়ে। সামনাসামনি এসে সৌদি আরব যেমন ইসরায়েলকে সাপোর্ট করেনি, তেমনি ইসরায়েলের তীব্র বিরোধিতাও করেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলবিরোধী পোস্ট করলে সৌদি আরবে গ্রেফতার করার খবরও পাওয়া গিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি প্রচ্ছন্নভাবে সৌদি ইসরায়েলকে সাপোর্ট করছে? আর ইরানের বিরোধিতা? দেখুন ইসরাইলবিরোধী মানে কিন্তু ইরানকে সাপোর্ট করার সম্ভবনা তুমুল। কূটনৈতিক মহল মনে করছে, সৌদিতে ইরানপন্থী একটা প্রভাবের বিস্তার ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই নাকি গ্রেফতার করা হচ্ছে বহু ব্যক্তিকে। মূলত যারা গাজায় চলমান হামাস আর ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করছে, তারাই পড়ছেন এই সমস্যায়। যদিও গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলবিরোধী অবস্থানের জন্য সৌদি আরবে মোট কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনটাই বলছে ব্লুমবার্গের রিপোর্ট।

 

দেখতে দেখতে প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। কিন্তু ইরান আর সৌদি আরবের অন্তরালে দ্বন্দ্ব লেগেই রয়েছে। দিনে দিনে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে শত্রুতা। আঞ্চলিক নানার লড়াইয়ে বিভিন্নভাবে জয়ী হচ্ছে ইরান, আর এটা কোথাও গিয়ে মেনে নিতে পারছে না সৌদি। সৌদি আরব মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে ক্রমবর্ধমান ইরানের প্রভাবে লাগাম টানা যায়। আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে ওদিকে বসে নেই ইরানও। সিরিয়াতে বহু বিদ্রোহী গ্রুপকে সমর্থন দিয়ে আসছিল সৌদি আরব। কিন্তু সেই সিরিয়ার মাটিতে সরকারি বাহিনী রাশিয়া আর ইরানের সাহায্য নিয়ে বিদ্রোহকে দমিয়ে দেয়। সৌদি আরব বুঝতে পারে, আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক উত্তেজনা। একটা সময় ছিল যখন সৌদি যুবরাজ ইরানি প্রভাব প্রতিহত করতে যুদ্ধ করেছে প্রতিবেশী ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সাথে। এখন ইরানের দিকে পাল্লাটা যেন একটু ভারী।

 

যুক্তরাষ্ট্রে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ছিলেন, কূটনৈতিক মহলের দাবী ছিল, সৌদি আরবকে নাকি সাহায্য জোগাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট। আর তেহরানকে নিয়ন্ত্রণে সৌদি আরবকে সমর্থন দিচ্ছে ইসরায়েল। বাইরের শক্তি আরো উস্কে দিচ্ছে দুই দেশের সম্পর্ক। এখানে কোথাও গিয়ে ইসরায়েলের একটা ভয়ের কারণ ছিল। কারণ ইরানের সমর্থনে যদি সিরিয়ার ইরানপন্থী যোদ্ধারা জয়ী হতে থাকে, তাহলে একসময় তারা ইসরায়েলের সীমান্তের কাছে চলে আসবে। বর্তমানে কিন্তু ঠিক তাই হয়েছে। ২০১৫ সালে ইরান আর পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে ইসরায়েল আর সৌদি আরব। মূল উদ্দেশ্য ছিল, পারমাণবিক বোমা বানানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে ইরানকে দূরে রাখা। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিকল্পনাটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ।

 

বিবিসির রিপোর্ট বলছে, বহু দশক ধরে চলে আসা এই শত্রুতা আরো তীব্র হয়েছে মূলত ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রই কিন্তু ইসলাম ধর্মের মূল দুটো শাখার অনুসারী। ইরান শিয়া মুসলিম বিশ্ব, আর অপরদিকে সৌদি আরব সুন্নি মুসলিম দুনিয়ায় শীর্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। একইভাবে যদি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন, কোন দেশে সুন্নি অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার কোন দেশে শিয়া অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর এই বিষয়টাকেই কেন্দ্র করে কোনো কোনো দেশ ইরানকে সাপোর্ট করে, আবার কোনো কোনো দেশ সাপোর্ট করে সৌদি আরবকে। একটা সময় সৌদি আরব নিজেকে দাবি করত মুসলিম বিশ্বের নেতা বলে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব আরবের সামনে তুলে ধরে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ।

 

আসলে কি বলুন তো, সম্পর্ক এত খারাপ হতো না। ছোট ছোট ফাটল গুলো একত্রে করলেই তো বড় ফাটলে পরিণত হয়। গত কুড়ি বছরে নানান ঘটনার জেরে দুই দেশের মধ্যে বিভেদ বাড়তে বাড়তে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। ইরানের বিরোধী ছিল অন্যতম বৃহৎ শক্তি ইরাকি প্রেসিডেন্ট এবং সুন্নি আরব নেতা সাদ্দাম হোসেন। যাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক অভিযানে ২০০৩ সালে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটা ইরানকে অনেকটা সুবিধা দিয়েছিল, যার কারণে ইরানের সামনে থেকে সরে যায় একটা বড় সামরিক বাধা। কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি। ২০১১ সালের নতুন করে আরব বিশ্বের দেশগুলোতে শুরু হয় তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা। তৎকালীন সময়ে এই সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলোকে বলা হতো আরব বসন্ত। সেই আগুনের আঁচ লেগেছিল, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশে। সেই সময় সৌদি আরব আর ইরান নিজেদের স্বার্থে ছিল একে অপরের বিপরীতে। দুই দেশই বিভিন্ন দেশে প্রভাব বাড়াতে থাকে। বিশেষ করে টার্গেটে ছিল সিরিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেনের মতো দেশগুলো। যার জেরে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে আরো তীব্র হয় পারস্পারিক সন্দেহ, অবিশ্বাস থেকে শুরু করে শত্রুতা।

 

যদি পরপর ঘটনা গুলো ক্রমান্বয়ে বলি, তাহলে প্রথমেই আসবে ২০১১ সালের ঘটনা। যেটাকে একটু আগেই বলা হলো আরব বসন্তের কথা। আবার ওই বছরই রয়েছে সিরিয়া যুদ্ধ। যেখানে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল ইরান আর সৌদি। শত্রুতা আরো গভীর হয় ২০১৫ তে এসে ইয়েমেনের যুদ্ধে। সম্পর্কের উত্তেজনা বাড়ে মক্কার এক ঘটনায়। সে বছর হজের সময় বহু মুসল্লির মক্কায় পদদলিত হয়ে মৃত্যু ঘটেছিল, যার মধ্যে বহু মানুষ ছিলেন ইরানের নাগরিক। তারপর দুজনে দুই দেশের সম্পর্ক ছিন্ন হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ তে এই সৌদি আরব তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো যেমন বাহরাইন, মিশর আর সংযুক্ত আরব আমিরাতকে নিয়ে কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপালে শুরু হয়ে যায় আঞ্চলিক সংকট। অভিযোগ ছিল, কাতার নাকি ইরানের মতো সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করছে। যদিও কাতার সেই অভিযোগ স্বীকার করেনি। মাঝখান থেকে আরো অবনতি ঘটে সৌদি আরব আর ইরানের সম্পর্কে।

 

২০১৮ তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রীতিমত একতরফাভাবে ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা করলে, সৌদি আরব আর ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে প্রশংসা করেছিল। যা একদমই ভালো মনে মেনে নিতে পারেনি ইরান। ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ থেকে সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থাপনায় ঘটতে থাকে একের পর এক হামলা, যার জেরে এক ধাক্কায় জ্বালানি তেলের উৎপাদন নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। এই ঘটনার জন্য সৌদি আরব ইরানকেই দোষারোপ করতে থাকে। অপরদিকে এসবের দায় শিকার করে এই ইয়েমেনের সরকার বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সম্পর্কের মধ্যে তীব্র তীব্রতা থাকা সত্ত্বেও ২০২১ আর ২০২২ সালে দুই দেশের প্রতিনিধি একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করেছে, কিন্তু সমস্যা মেটেনি। হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে বন্ধ ছিল তেহেরান আর রিয়াদের কূটনৈতিক সম্পর্ক। তার উপর আট বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইয়েমেন যুদ্ধে পরস্পর বিরোধী অবস্থানেই থেকেছে দুই দেশ। একদিকে ইয়েমেনের সরকারের পক্ষে ছিল সৌদির নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট , অপরদিকে বিরুদ্ধে ছিল ইরান সমর্থিত হুতি যোদ্ধারা। দুই দেশ যতাদের বৈরী সম্পর্ক জোড়া লাগাতে রাজি হয়নি, এমনটাও নয়। বেজিংয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে একটা বৈঠক হয়েছে। যেখানে সৌদি আরব এবং ইরানের মতের মধ্যে অনেকটা মিল ছিল। দুই দেশই তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করতে এবং দূতাবাসগুলো আবার খুলতে রাজি হয়। এটা গত বছরের ঘটনা।

 

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরান আর সৌদি আরব একে অপরের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি, ঠিকই , কিন্তু তারা লিপ্ত রয়েছে নানান ছায়া যুদ্ধে। যার বড় প্রমাণ, সাম্প্রতিক সময়ে নানান ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতে যখন সমর্থন আর সহযোগিতার প্রশ্ন আসে, তখন তারা একে অপরের বিরোধীপক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, যদি দুই দেশের মধ্যে কখনো সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যায়, তাহলে সেটা হতে পারে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা। কারণ পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version