Byomkesh O Durgo Rahasya: “ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য”–ছককষা ভাল বুদ্ধিদীপ্ত প্যাকেজ, পপকর্ন সহযোগে উপভোগ্য

।। রণজিৎ দে ।।

Byomkesh O Durgo Rahasya: ইদানিং ব্যোমকেশ বানাবার যে ঢল নেমেছে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, সেগুলোর থেকে দেব-বিরসার ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য’ যে অনেকটা আলাদা, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথায় ঠিক আলাদা? মেকিং স্টাইল এবং ব্যোমকেশের উপস্থাপনায়। আর এখানেই এই ছবি আর পাঁচটা ব্যোমকেশ থেকে নিজের দূরত্ব তৈরি করেছে।

এই ছবিতে ব্যোমকেশ কেবল একজন ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত ‘সত্যান্বেষী’ নয়, তার একটা হিরোগিরিও আছে। সংলাপের পাঞ্চে,  আকশান সিকোয়েন্স-এ, সিনেমায় প্রথম আবির্ভাবের চমকে। অথচ কোথাও খুব একটা বাড়াবাড়ি নেই। সব কিছু বেশ মানানসই। দেব এবং বিরসার এই পরিশীলিত বোধই  ছন্দপতন হতে দেয় না। বাঙালির নস্ট্যালজিক সেন্টিমেন্টকে আহত করে না। এই কাজটা মোটেই খুব একটা সহজ ছিল না। দেব-বিরসা উতরে গেছেন। এবার সেই মোক্ষম প্রশ্ন, দেব ব্যোমকেশ হিসাবে কেমন? এখানেই বুদ্ধিদীপ্ততা দেখিয়েছেন দেব এবং বিরসা। সব বাঙালিই জানে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ ‘সেরিব্রাল’। এই ইমেজটাকেই মাথায় রেখে পরিচালকরা বার বার ব্যোমকেশ নির্বাচন করেছেন সিনেমার জন্য। তাই কখনও আবীর এসেছে, অনির্বান এসেছে, কখনওবা যিশু। আর এই কারণেই সবাই ভুরু কুঁচকে ছিল দেব-এর ব্যোমকেশ করা নিয়ে! দেবের সীমাবদ্ধতা এত দিনে গোটা বাঙালি জানে, তার থেকেও বেশি নিজেকে জানেন দেব স্বয়ং। আর জানেন বলেই ব্যোমকেশের স্বতঃপ্রণোদিত ‘সেরিব্রাল’ ইমেজকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করার পথে না হেঁটে, পরিশীলিত ‘হিরোগিরি’ দিয়ে তা ব্যালেন্স করার চেষ্টা করেছেন তিনি, যা সুপারস্টার দেবের সঙ্গে একেবারে মানানসই। এখানেই দেব-বিরসার বুদ্ধিদীপ্ততা। অভিনয় নয়, লুক নয়, নিজের সম্পর্কে এই নিখাদ, নির্ভীক, নির্ভেজাল আত্ম-সচেতন বোধই দেবের ব্যোমকেশকে বাঙালির মনে ধরেছে।

এই ছবির মেকিং স্টাইলেও রয়েছে গোয়েন্দাসুলভ চমক। এ একেবারেই পরিচালনার মুন্সিয়ানা। কী সেই চমক? এই যেমন দেবের এন্ট্রি- সিকোয়েন্সের কথাই ধরুণ, সত্যবতী আর অজিত ব্যোমকেশের কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরা নিয়ে যখন কথা বলায় মশগুল, পর্দায় আমরা হ্যাট-প্যান্ট পরা একজনের উপস্থিতি দেখতে পাই, এ অতি চেনা সিনেমাভাষার প্রয়োগ। তাই সেই বোধ থেকে যখনই তাকে আমরা দেবের এন্ট্রি বলে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে যাব, ঠিক তখনই রহস্য ফাঁস হয়ে যাবার মত দেখতে পাব তিনি দেব নন, ঝটকা খাব। এই ক্লিশেড প্রয়োগকেই এই ছবিতে বার বার ভেঙেছেন বিরসা। এইভাবে কোডিং-ডিকোডিং ফর্মূলাকে সিনেমার ভাষায় দারুন ব্যবহার করেছেন পরিচালক।  ছবির শেষে এই শৈলীর প্রয়োগ দুর্দান্ত। এই ছবিতে সত্যবতী গর্ভবতী। শেষের দিকে ব্যোমকেশ খুনির হাতে যখন বিপর্যস্ত, কাট করে আমরা দেখতে পাই মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, সত্যবতী চিৎকার করে বীনা দিদিকে ডাকছে। আমরা ব্যোমকেশ-সত্যবতীর বিপদ নিয়ে যখন নিশ্চিত এবং আশাহত, ঠিক তখনই আবার কোডিং-ডিকোডিং ফর্মূলা চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক যা এই থ্রিলার ছবির আমেজের সঙ্গে দারুণ খাপ খেয়েছে।

এই ছবির মেকিং-এ চিন্তাশীলতার ছাপ ফুটে ওঠে। ছবিতে ‘প্ৰপস’ একটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। একটু খেয়াল করলে দেখব, যে যে ‘প্ৰপসগুলো’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ন, ক্যামেরা আঙ্গেল-এর মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই হিন্টস রেখেছেন বিরসা, ছবি শেষে  আমরা গোয়েন্দা হয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে ধরতে পারব। আর এখানেই থ্রিলার ছবির আমেজকে সিনেমার ভাষায় দেখাবার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক। আরেকটা কারণে এই ছবি ভাল, তা হল থ্রিলার ছবির প্রাণ ভোমরা হল যুক্তি। কেন করল? কে করল? কী ভাবে করল? এই ছবি শেষ অবধি সেই যুক্তিকে ধরে রেখেছে। অবশ্য অসঙ্গতি আছে। খুনি যখন একজনের পা-এ বার বার আঘাত করছেন, পরে আমরা দেখি সেখানে কেবলই দুটো সর্প দংশনের ফুটো! আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ আসল ‘প্ৰপস’ সরিয়ে নেওয়া দেখানো হলেও কী ভাবে ‘নকল’ ‘প্ৰপস’ সেখানে এল, সেটাও খুব একটা স্পষ্ট নয়!

আলাদা করে সত্যবতীর চরিত্রে রুক্মিনী এবং অজিতের চরিত্রে অম্বরীশের কথা বলতে হয়। রুক্মিনীকে দেখতে বেশ লাগে। অভিনয় করছেন বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা ছাপিয়ে যায় ওঁর সত্যবতী হয়ে ওঠার অদম্য চেষ্টা। এই চেষ্টাকেই কুর্নিশ। অজিতের ভূমিকায় অম্বরীশ চমৎকার। বেশ একটা কমিক রিলিফ। মনিলালের চরিত্রে সত্যম নিজের জাত চিনিয়েছেন। রজতাভ, শান্তিলাল যে কোনও ছবিরই ব্যাকবোন, এই ছবিতেও তাই। এই ছবির মিউজিক বেশ। দুটো গানের ব্যবহার খুব সুন্দর। ‘ব্যোম ব্যোম ব্যোমকেশ’ গানটার ব্যবহার তো খুবই যথাযথ।

এক কথায় ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য’ ছককষা ভাল বুদ্ধিদীপ্ত একটা প্যাকেজ। কেন বুদ্ধিদীপ্ত তা আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু এই ছক কষে ফর্মূলা মাফিক প্যাকেজ বানিয়ে একদিকে যেমন এই ছবি নিজেকে একটা ‘সেফ জোন’-এ রাখতে সক্ষম হয়েছে,তেমনি এই ফর্মুলা মাফিক প্যাকেজ অনেক সম্ভাবনাকে নষ্টও করেছে। এই ছবি আর পাঁচটা ব্যোমকেশ থেকে আলাদা ঠিকই, কিন্তু এক্সপেরিমেন্টাল ব্যোমকেশ নয়, যা দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেখিয়েছিলেন। এত ইতিহাস, এত ইনফরমেশন, ‘হিরো’ ব্যোমকেশ-এর প্রতিষ্ঠা, এত কিছু প্রতিষ্টা করতে গিয়ে ছবিজুড়ে রুদ্ধশ্বাস ব্যাপারটা হোঁচট খেয়েছে। দর্শকও পপকর্ন ফেলে নিজের মগজাস্ত্র খাটিয়ে গোয়েন্দা হবার তাগিদ অনুভব করেননি, যা একটা থ্রিলারের সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু তা না-ই বা হল! ছুটির দিনে সপরিবারে পপকর্ন খেতে খেতে দেবের ব্যোমকেশ দেখার মজাকে তা বলে অস্বীকার করা যায় না কোনও ভাবেই। এখুনি টিকিট কেটে ফেলুন–‘ব্যোম ব্যোম ব্যোমকেশ’!

 

খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়

সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম

Exit mobile version