।। প্রথম কলকাতা ।।
Reserve: রিজার্ভ শব্দটাই যেন গোলমেলে, যা বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির চাকা। আন্তর্জাতিক মহল থেকে এনে দিতে পারে প্রশংসার শিরোপা। যে দেশের যত রিজার্ভ, সেই দেশের ততই নামডাক। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের রিজার্ভে ধস নেমেছে। এশিয়ার বেশ কিছুদেশ রিজার্ভ ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তা পারছে না। রিজার্ভের অভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ কমার ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে বাংলাদেশ ভারতের মতো এশীয় দেশগুলি। কিন্তু কি এই রিজার্ভ? আর এই রিজার্ভ নিয়ে এত মাথা ব্যাথা কেন?
রিজার্ভ বলতে বোঝায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যত পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা থাকে , সেটি হলো সেই দেশের রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে এই রিজার্ভ নিয়ে কম বিতর্ক নেই। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের রিজার্ভ তরতরিয়ে উপরদিকে উঠছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রটা একেবারে পাল্টে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। যা বাংলাদেশ সরকারের মাথা ব্যাথার অন্যতম কারণ।
২০২২ সালের মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯.৬৫ বিলিয়ন ডলার কমে দাঁড়ায় ৬২২.২৭ বিলিয়ন ডলারে। যা গত দুবছরের তুলনায় সব থেকে বড় পতন। যার অন্যতম কারণ, আরবিআই রূপির মূল্যের পতন রোধ করতে প্রচুর পরিমাণে ডলার বিক্রি করেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সেপ্টেম্বরের দিকে প্রায় ২.২৩৪ বিলিয়ন ডলার কমে ভারতের রিজার্ভ পৌঁছায় ৫৫০.৮৭১ বিলিয়ন ডলারে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, চলতি বছরের শেষে ভারতের রিজার্ভ ৫১ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে ভারতের রিজার্ভে ৫০ হাজার কোটি ডলার থাকা যথেষ্ট। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ ৩৬.৪৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অর্থাৎ আই এম এফ হিসাব করার যে পদ্ধতি সুপারিশ করেছে, সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২৭ বিলিয়ন ডলারে। ডলারের হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে চীনের ভাণ্ডারে। যার পরিমাণ প্রায় তিন ট্রিলিয়ন বা ৩০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার। রিজার্ভ মানেই শুধুমাত্র ডলার সঞ্চয় নয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা এবং সোনাও থাকতে পারে। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মার্কিন ডলার সবথেকে বেশি রিজার্ভ করে। এর অন্যতম কারণ তার কারণ বিশেষ সবচেয়ে প্রচলিত স্থিতিশীল মুদ্রা হল মার্কিন ডলার।
রিজার্ভ কোথা থেকে আসে?
স্পষ্ট কথায় রিজার্ভ বলতে বোঝায় কোন দেশের ভাঁড়ারে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা। তা বিভিন্ন উপায়ে আসতে পারে। তবে রিজার্ভের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন বিদেশে কর্মরত মানুষরা অর্থাৎ কোনো দেশের প্রবাসীরা। তাদের পাঠানো বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভের একটি বড় অংশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে প্রবাসীদের আয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও রয়েছে রপ্তানির আয়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, গার্মেন্টসের দিক থেকে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে। দেশটি শিল্প পণ্য ছাড়াও সেবা পণ্য রপ্তানি করে মোটা রিজার্ভ অর্জন করে। এছাড়া অনেক সময় বিদেশি বহু বিনিয়োগকারী সরাসরি কোন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বিনিয়োগ করে। যা জমা হয় রিজার্ভে। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের থেকে নেওয়া ঋণ সরকারের রিজার্ভের একটি বড় অংশ।
রিজার্ভ এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি বলেই দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক দেশ গুলি থেকে নেওয়ার ঋণ বা আমদানিকৃত দ্রব্যের ক্ষেত্রে রিজার্ভের প্রয়োজন পড়ে। রিজার্ভ না থাকলে সেই দেশ কখনোই আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। এছাড়াও ঋণ পেতে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর দেশগুলির ক্ষেত্রে রিজার্ভ থাকা মানে সেই দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে সচ্ছল। ভাঁড়ারে যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ আছে মানে, সেই দেশ দেশের সরকার অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বস্তিতে রয়েছে। রিজার্ভের ভান্ডার কমা মানে মারাত্মক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে, যা স্বর্ণ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। যুদ্ধ কিংবা আন্তর্জাতিক সংকটের ক্ষেত্রে বহু বৈদেশিক বিনিয়োগকারী রিজার্ভ কম আছে এমন দেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। বিনিয়োগকারীদের কাছে নিজেদের বিশ্বস্ত করে তুলতে সেই দেশের যথেষ্ট পরিমাণের রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন। কোনো দেশের রিজার্ভ ভালো পরিমানে থাকলে বিনিয়োগকারীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ক্ষতিপূরণ ঋণ এবং বিল পরিষদের ক্ষেত্রে রিজার্ভে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশ পায়রা সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে কিছুটা বিনিয়োগ করেছে। যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ থাকলে যে কোনো দেশ অর্থনৈতিক সংকট থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে ।সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রায় ৪৮৯ কোটি ডলার রিজার্ভ বিক্রি করে চার মাসের জ্বালানি এবং সার আমদানি করেছে। তবে শুধুমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণের মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষণ হয় না। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ান কানাডিয়ান সিঙ্গাপুরি মুদ্রার পাশাপাশি স্বর্ণ দিয়েও রিজার্ভ করে। এছাড়া রিজার্ভে রয়েছে ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, চীনের ইউয়ান এবং জাপানের ইয়েন।
স্থানীয় মুদ্রার মূল্যমান নির্ধারণের রিজার্ভ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের বহু দেশে রপ্তানি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে ডলারের তুলনায় দেশের মুদ্রার মূল্যবান একটু কম রাখে।দেশের মুদ্রার মূল্য যাতে কম না হয়, তাই ভাল রিজার্ভ ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই অনেকে ডলারের বিপরীতে সবসময় মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে। চীন সর্বদা তাদের ইউয়ানের মূল্য নির্ধারণ করে মার্কিন ডলারের সঙ্গে তুলনা করে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেশ কয়েকবার ডলারের দাম ঠিক রাখতে বাজারে হস্তক্ষেপ করেছিল। জাপানও বাজারে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করে থাকে, যাকে বলা হয় ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম। দেশের সংকট সংকোচে রিজার্ভ বিক্রি করতে পারে সেই দেশের সরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি রপ্তানির গতি সচল রাখতে কোন দেশের যদি হঠাৎ অর্থ পরে দরকার পড়ে তাহলে রিজার্ভ বিক্রি করে সেখান থেকে সেই অর্থ সংগ্রহ করে।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম