।। প্রথম কলকাতা ।।
গত ১ দশক ধরে বিশ্বের তাবড় তাবড় বোলারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন যিনি, তিনি বিরাট কোহলি। সাফল্য আর ব্যর্থতাকে সরিয়ে রাখলে ভারতীয় ক্রিকেটে বিরাট কোহলির অবদান অনস্বীকার্য। যার শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালের ১৮ই আগস্ট। ভারতের জার্সি গায়ে চাপানোর পর থেকে একের পর রেকর্ড গড়ে গিয়েছেন কোহলি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৪ হাজার রানের মালিক তিনি। ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে সবথেকে বেশি টেস্টে জয় আছে কোহলির নামের পাশেই। তাঁর অধিনায়কত্বেই টেস্ট ক্রিকেটে টানা পাঁচ বছর শীর্ষস্থানে ছিল ভারত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭১টি সেঞ্চুরির মালিক বিরাট কোহলি।
এহেন বিরাট কোহলির ক্রিকেট ক্যারিয়ারেও নেমে এসেছিল ঘন অন্ধকার। তবে লড়াই আর প্রত্যাবর্তন যে তাঁর রক্তে। ২০০৬ সালে হার্ট অ্যাটাকে বাবার মৃত্যু ভেঙে দিয়েছিল বিরাট কোহলিকে। তবে দৃঢ়তা আর অদম্য মনের জেদ আটকাতে পারেনি তাঁকে। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেও সেদিন ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিলেন বিরাট। খেলেছিলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। বাবার মৃত্যুই তাঁর জীবনের মোর ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কোহলির জীবনের আদর্শ ছিলেন তাঁর বাবা। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ভারতীয় দলে খেলবে। বাবার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে জাতীয় দলে করে গেছেন একের পর এক সেঞ্চুরি। গড়ে গেছেন অনন্য সব রেকর্ড। ২০১১ সালে বিশ্বকাপে বেশ কয়েকটা ইনিংস খেলে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের তরুণ প্রজন্মের আইকন।
এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিরাট কোহলিকে। বিশ্ব ক্রিকেটের আঙিনায় করে গেছেন একের পর এক রেকর্ড। তবে ছন্দপতন হয় ২০১৯ সালের পর। টানা খারাপ ফর্ম বিরাটকে ঠেলে দেয় বিষাদ আর অন্ধকারে। একের পর এক ম্যাচে অফফর্ম, ডাগআউটে বসে চোখের জল লুকিয়ে কেঁদেছিলেন তিনি। বিতর্ক তৈরি হয়েছিল তার অধিনায়কত্ব নিয়েও। বাদ পড়েন অধিনায়ক থেকেও। বিগত তিন বছরে জীবনের সব থেকে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন বর্তমান ক্রিকেটের অন্যতম ব্যাটার। বিরাট কোহলি ক্যারিয়ারের এতটা খারাপ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে শেষ কবে গিয়েছেন, তা অনেকেই মনে করতে পারবেন না হয়তো। বহু কটাক্ষ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন বিরাট। কেউ তাঁকে বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছেন তো আবার কেউ বলছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে। এমনকি ভারতীয় দলে কোহলির জায়গা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্তন ক্রিকেটার কপিল দেব থেকে ভেঙ্কটেশ প্রসাদ ভারতীয় দলে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ফি-ম্যাচে সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলিও টানা তিন বছর অপেক্ষা করেছেন একটি সেঞ্চুরির জন্য।
তবে ভেঙে পড়েননি তিনি। সব ব্যর্থতাকে তুড়ি মেরে মনের অদ্যম জেদে এগিয়ে গেছেন। রাতের পর রাত প্র্যাকটিস। নিজের দলের অনুশীলন শেষ হলেও প্রতিপক্ষ দলের অনুশীলনে নেমে পড়েছেন ব্যাট হাতে। নামটা যে বিরাট কোহলি। লড়াই তাঁর শিরায় শিরায়। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে কর্ম করলে ফল ঠিকই পাওয়া যায়। তাই ক্রিকেট দেবতাও হয়তো মুখ ফিরিয়ে আর থাকতে পারেননি। সবকিছুকে পিছনে ঠেলে আবারও শীর্ষে বিরাট কোহলি। একটা সময় ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট বিরাটকে টিম থেকে ছেঁটে ফেলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঠিক সেই জায়গা থেকে কামব্যাক কিং কোহলির। এশিয়া কাপে প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি করেই বার্তা দিয়েছিলেন তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। দেশকে যে অনেক কিছু দেওয়ার বাকি।
তবে এই সেঞ্চুরির পরও বিরাটের দিকে ভেসে এসেছিল কটাক্ষ আর সমালোচনার ঝড়। সহজ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি এ আবার গৌরবের কী! তবে হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করে গেছেন বিরাট। ফর্মে তো তিনি ফিরেছেন, তবে সমালোচনার জবাব আর নিজের গৌরব ফিরে পেতে দরকার ছিল একটি বড় মঞ্চ। আর তাই হয়তো বেছে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চকেই। ফিরলেনও ছাইয়ের স্তুপ থেকে বেরিয়ে আসা আহত ফিনিক্স পাখির মতো। ঐতিহাসিক মেলবোর্নে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাটের মায়াবী ছোয়াঁয় মাতিয়ে দিয়ে গেলেন বিরাট কোহলি। ম্যাচ শেষে বিরাটের চোখের জলই বুঝিয়ে দিয়েছিল লড়াই তার কত কঠিন ছিল। জীবনে বহু ঝড়-ঝাপটা সামলে বিরাট কোহলি হয়ে উঠেছেন বিপক্ষ বোলারদের শিরদাঁড়া ভাঙার কারিগর।