।। প্রথম কলকাতা।।
Gauriprasanna Majumdar: সুরের ভুবনে বাস করতেন তিনি। আধুনিক বাংলা গানের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দের মত শিল্পীর গলায় যাঁর গান শোভা পেয়েছে, সেই গীতিকার বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অদ্বিতীয় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্মদিন আজ। তাঁর কলম দিয়ে ‘যদি কাগজে লেখ নাম’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ ইত্যাদি বহু কালজয়ী গান বেরিয়েছে।
১৯২৪-এর আজকের দিনে পাবনার গোপালনগর গ্রামে এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। বাবার নাম গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার, মায়ের নাম সুধা মজুমদার। বাবা ছিলেন একজন ভারত বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী, সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপকও। মা কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসতেন। সেকালের মেয়ে হলেও পড়াশোনায় ছিলেন তুখর, স্নাতক উত্তীর্ণ করেছিলেন তিনি। এক কথায় বলতে গেলে তাঁর রক্তে ট্যালেন্ট ছিল। ছোটবেলা থেকে বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের চর্চা হত গৌরীপ্রসন্ন’র বাড়িতে। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে। স্কুলে পড়াকালীনই বাংলা কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন এই ব্যক্তিত্ব। কিন্তু একটি মাসিক পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা না হওয়ায়, বাংলার বদলে ইংরেজিতে কবিতা লিখতে থাকেন।
১৫ বছর বয়সে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯৪০ সালে। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। বাবার ইচ্ছে থাকলেও সিভিল সার্ভিস পড়তে ইংল্যান্ড তিনি যাননি। কেননা ভালবাসতেন বাংলা গান। গ্রামাফোন রেকর্ডের গান শুনে সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মেছিল তাঁর। বেহালা শেখেন মিহিরকিরণ ভট্টাচার্যের কাছে। কলেজে পড়াকালীন তাঁর পরিচয় হয় সঙ্গীত শিল্পী বিমলভূষণের সঙ্গে। গৌরীপ্রসন্ন’র ‘আমি বুঝতে পারি না কি আছে তোমার মনে’ ও ‘শুধু পত্র ঝরায় অলস চৈত্রবেলা’ বিমলভূষণ নিজের কন্ঠে রেকর্ড করেছিলেন।
বাংলা গানের জগতে মান্না দে, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিখ্যাত মানুষদের কন্ঠে শোভা পেয়েছে তাঁর লেখা। শচীন দেববর্মণের সুরে আর তাঁর কথায় ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ ইত্যাদি জনপ্রিয় গান সৃষ্টি হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বহু গানের কথাও লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন। তার মধ্যে ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘আজ দু’জনার দুটি পথ’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-এর মত গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘প্রতিদান’ ছবির ‘মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে’ গানটি একটি খালি সিগারেটের প্যাকেটে লিখে দিয়েছিলেন তিনি। শক্তি সামন্তের ছবি ‘আরাধনা’র বিখ্যাত গান ‘মেরে সপনো কি রানি’, ‘গুনগুনা রহা হ্যায় ভবরেঁ’ গান দুটির বাংলা করেছেন তিনি। সারা জীবন ধরে অসংখ্য চলচ্চিত্রের গান লেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ছবি ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ তাঁরই লেখা। এমনকী বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ যান গৌরীপ্রসন্ন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। যা সেই সময় আকাশবাণীতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝে মাঝে বাজানো হয়েছিল। গানটিতে সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেন অংশুমান রায়। এমনকি ওই গানের ইংরেজি অনুবাদও বের হয়। গানটির নাম ‘শোনো একটি মুজিবুরের থেকে’। ১৯৮৬ সালের ২০ অগাস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর মৃত্যুতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘গৌরীদা ক্যানসারে মারা যান। তাঁর মত এত বড় একজন গীতিকার বম্বের অতি সাধারণ এক হাসপাতালে প্রায় মাটিতে শুয়েই শেষের দিন গুনেছেন’। তাঁর মতো প্রতিভাবান ব্যক্তি খুব কমই ছিল। বাঙালি জাতিতে এইরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ ও আধুনিক গানের দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম