যে রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে পুরো পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবেন | Prothom Kolkata

পৃথিবীর দীর্ঘতম হেঁটে যাওয়ার পথ: এক অবিশ্বাস্য অভিযান

পৃথিবীতে অগণিত রাস্তা থাকলেও, একটি রাস্তা শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, বরং এক অনন্য এবং অবিশ্বাস্য অভিযানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ হেঁটে যাওয়ার পথটি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে রাশিয়ার মাগাদান পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অসাধারণ পথটি তিনটি মহাদেশ; আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত, যা প্রকৃতি ও মানুষের মিলিত প্রয়াসে গঠিত হয়েছে।

 

এই রাস্তা ধরে হাঁটলে কেউ বিমান, ট্রেন, বাস বা লঞ্চের সাহায্য নিতে হবে না। একেবারে একটানা হেঁটেই পাড়ি দেওয়া সম্ভব বিশাল এই দূরত্ব। পুরো পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২,৩৮৭ কিলোমিটার। প্রতিদিন যদি ৮ ঘণ্টা করে হাঁটা হয়, তবে পুরো পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে প্রায় ৫৮৭ দিন। আর যদি বিরতিহীন হাঁটা হয়, তবে এই পথ শেষ করতে প্রায় ১৯৪ দিন লেগে যাবে। এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর দীর্ঘতম হাঁটা পথ হিসেবে স্বীকৃত।

 

এই মহাযাত্রা শুরু হবে আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দু, লা আগুলাস গ্রাম থেকে। এখান থেকে হাঁটা শুরু করলে প্রথমেই পড়বে বিস্তীর্ণ বনভূমি, খরাপ্রবণ অঞ্চল এবং কিছু বিপজ্জনক পথ। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চলার পথে দেখা মিলবে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, জনপদ, বন্যপ্রাণী ও প্রতিকূল পরিবেশের।

 

প্রথমেই পড়বে বোতসোয়ানা ও জিম্বাবুয়ে—যেখানে হাতি, সিংহ, গন্ডারসহ বহু বন্যপ্রাণীর বিচরণ রয়েছে। এরপর জাম্বিয়া হয়ে তানজানিয়া, যেখানে আফ্রিকার অন্যতম ন্যাশনাল পার্কগুলোর মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে। এখানে দেখা মিলবে আফ্রিকার বিখ্যাত বন্যপ্রাণীদের, যা যেকোনো ভ্রমণকারীর জন্য হবে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

 

এরপর পথে পড়বে উগান্ডা, যেখানে হাঁটার পথে যেতে হবে বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্কের পাশ দিয়ে। তবে এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নির্জন এলাকায় খাবার ও পানীয় জোগাড় করা। এরপর দক্ষিণ সুদান, যা যেকোনো ভ্রমণকারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা। চুরি, ডাকাতি ও যুদ্ধবিগ্রহের জন্য কুখ্যাত এই দেশ, যেখানে রাতের বেলা একা চলাচল করা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

 

দক্ষিণ সুদান পেরিয়ে হাঁটতে হবে সুদান হয়ে সাহারা মরুভূমির অংশবিশেষ। এই মরুভূমি পাড়ি দেওয়া সবচেয়ে কঠিন কারণ সেখানে খাবার, পানি, ছায়া বা বিশ্রামের জায়গা পাওয়া খুবই দুষ্কর। যারা সাহারা পার হতে পারেন, তারা এই দীর্ঘ হাঁটা অভিযানের অন্যতম কঠিন ধাপ সম্পন্ন করবেন।

 

এরপর প্রবেশ করতে হবে মিশর, যেখানে ইতিহাস আর আধুনিকতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ রয়েছে। এখান থেকে হাঁটা শুরু হবে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, যেখানে প্রথমেই পড়বে জর্ডান। জর্ডান থেকে ইসরায়েল হয়ে সিরিয়া, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল অতিক্রম করতে হবে। সিরিয়া থেকে তুরস্কে প্রবেশ করা আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল নয়।

 

তুরস্ক পার হওয়ার পর হাঁটতে হবে জর্জিয়া হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত। রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড অতিক্রম করতে হবে, যেখানে আবহাওয়া হবে ভয়ংকর ঠান্ডা, বিশেষ করে সাইবেরিয়ার অঞ্চল। এ অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে হেঁটে চলার জন্য শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক দৃঢ়তা দুটোই প্রয়োজন।

 

রাশিয়ার এই বরফাচ্ছন্ন পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছাতে হবে মাগাদান, যা এই অভিযানের চূড়ান্ত গন্তব্য। যাত্রার শেষ দিকে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, দুর্বল রাস্তা, তুষারপাত এবং খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হতে হবে, যা একজন অভিযাত্রীর জন্য হবে এক ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ।

এই দীর্ঘ হাঁটা পথে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো বিশ্বরেকর্ড করেননি। কারণ, এই পথের অনেক দেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, যেমন দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া। আবার কিছু দেশে ভিসা জটিলতা, বৈরি আবহাওয়া ও খাদ্যসংকট এই ধরনের অভিযানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

 

এছাড়া, পুরো পথ হেঁটে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে প্রচণ্ড ধৈর্য ও শারীরিক সক্ষমতা। একবার এই অভিযানে বের হলে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। মরুভূমি, বরফাবৃত অঞ্চল, বন্যপ্রাণীর বসবাসস্থল, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা—এই সবকিছু পার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা শুধু শারীরিক নয়, বরং মানসিক ও আত্মিক শক্তির পরীক্ষাও। যে কেউ এই পথ ধরে হাঁটতে চাইলে তারা বিশ্বের বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন দেখতে পাবেন, বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং নিজেকে এক নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন।

 

এই পথের প্রতিটি ধাপই এক নতুন গল্পের জন্ম দেবে। দক্ষিণ আফ্রিকার উষ্ণতা থেকে শুরু করে রাশিয়ার তুষারপাত—এই পুরো পথ হাঁটা মানে এক পৃথিবীর অভিজ্ঞতা নিজের মধ্যে ধারণ করা। এখন পর্যন্ত কেউ এই পুরো পথ হেঁটে যাননি, তবে ভবিষ্যতে হয়তো কোনো দুঃসাহসী অভিযাত্রী এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। তিনি হবেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই অবিশ্বাস্য পথে হেঁটে ইতিহাস গড়বেন।

 

Exit mobile version