।। প্রথম কলকাতা ।।
India-China-Russia: পররাষ্ট্রনীতিতে কি ফ্লপ জো বাইডেন? জোট বাঁধছে ভারত, রাশিয়া আর চীন! ফিকে হয়ে যাচ্ছে চীন ভারতের শত্রুতা! এও কী সম্ভব? বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির সামনে হঠাৎ এমন প্রশ্ন উঠছে কেন? বিশ্বে মার্কিনি মোড়লগিরি কমাতে এক হতে পারে দিল্লি, মস্কো আর বেজিং। ভবিষ্যতে এর ফলটা হতে পারে মারাত্মক। আখেরে লাভ কার বেশি? যুক্তরাষ্ট্রই সেরা, এই চেনা পুরনো অঙ্কটা আর কাজে আসবে না। চীন আর ভারতের দ্বন্দ্ব মেটাতে আগ্রহী রাশিয়া। ভারতকে পুতিনের এত পছন্দ কেন?
ভারতে এখন চলছে লোকসভা নির্বাচন। গোটা বিশ্বের কাছে এই নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ক্ষমতায় কে আসছে, মোদী সরকার ক্ষমতায় ফিরবে, কি ফিরবে না, এটা এখন পাখির চোখ বিশ্বের বহু দেশের পররাষ্ট্রনীতির কাছে। তবে বিভিন্ন জরিপ এবং সমীক্ষার আভাস বলছে, হয়ত বা পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে মোদী সরকার। আর মোদী সরকার ক্ষমতায় এলে লাভ হবে বহু দেশের। এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ মোদী সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রো মত রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে ভারত একটা শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পাচ্ছে। শুধু এশিয় দেশ নয়, মুসলিম প্রধান দেশ মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও মজবুত হয়েছে ভারতের সম্পর্ক।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে পারে এবার ভারত, চীন আর রাশিয়ার জোট। কি, এটা শুনে একটু অবাক লাগছে তো? কারণ চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের তিক্ততা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করবেন, ভারতের কাছে প্রতিবেশী দেশগুলো ভীষণভাবে গুরুত্ব পায়। ভারত চলে ‘ প্রতিবেশী প্রথম ‘ নীতিতে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, দুই দেশ ভবিষ্যতে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে জোর দিতে পারে। লাভ কিন্তু দুই দেশেরই। হয়তো বা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কমাতে, ভারত আর চীনের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে রাশিয়া। বদলে যেতে পারে পুরো ছক। একটা সময় মার্কিন জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, এই ধারণা ফিকে হয়ে আসার সময় হয়ে এসেছে।
দশকের পর দশক গোটা বিশ্বে মোড়লগিরি চালালেও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে মার্কিন আধিপত্য। যার মূলে কুঠারাঘাত করছে ডলারের দুর্বলতা। আসলে এই ডলারকে কেন্দ্র করেই তো এত কিছু। গত ২ দশকে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের শেয়ার ৭২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। এই দুর্বলতার জায়গা থেকেই হয়ত, গোটা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। এই ধরুন, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করা, ইরান আর ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলের পাশে থাকা সহ এরকম বহু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে দেশটা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময় কানাডা ভারতের দ্বন্দ্বে দিল্লির পাশে ছিল ওয়াশিংটন। আদতে এখানে যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল ভূরাজনীতির দর কষাকষি করতে। চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে প্রক্সি হিসেবে হয়তো ব্যবহার করতে চাইছে দেশটা। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায়, ভারত অত্যন্ত স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং নীতিও নিরপেক্ষ। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, চীন রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মার্কিনিদের টেক্কা দিতে ভারতকে পাশে পেতে চাইছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা বিশ্ব ব্যবস্থার সামনে তুলে ধরেছে একটা বহুমুখী পথ। যেখানে একটা দেশ নয়, ক্ষমতা থাকতে পারে বহু দেশ। এশিয়া থাকতে পারে, ইউরোপ থাকতে পারে কিংবা মধ্যপ্রাচ্য। রাজনৈতিক স্বার্থে, ভারতকে এখন কাছে টানা লাভের বলে মনে করছে পরাশক্তি গুলো। কারণ ধীরে ধীরে গ্লোবাল পাওয়ার হয়ে উঠছে ভারত। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এমনি থেকেই বেশ ভালো। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও কিন্তু ভারত অত্যন্ত নিরপেক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে ব্যালেন্স করেছে, এখনো করছে। মনে করা হচ্ছে, প্রযুক্তিগতভাবে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেই জায়গায় ভারত চীন রাশিয়ার জোট একদিন নেতৃত্ব দিতে পারে। রাশিয়ার কাছে এখন বেস্ট অপশন হয়ে উঠেছে ভারত। তেল বিনিয়োগের পাশাপাশি বহু স্টার্টআপে অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে মস্কোর। ভারতের সেই সুযোগ হাত ছাড়াও করতে চাইছেন না পুতিন। হয়তো বা, কয়েক দশক পর কিংবা কয়েক বছর পর নিজের স্বার্থে রাশিয়া ভারত আর চীনের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে, এমনটাই আভাস দিচ্ছে ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে, যখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল, তখন কিন্তু রাশিয়া তেল বিক্রির অন্যতম জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে ভারতকে। দিল্লির সঙ্গে আরও নৈকট্য বাড়ে মস্কোর। পাশাপাশি দুই দেশ সামরিক এবং প্রযুক্তি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করে। কথা হয়, যৌথভাবে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র উৎপাদন এবং উন্নয়ন বিষয়েও। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার অতিক্রম করেছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। অঙ্কটা নেহাত কম নয়। আর এই প্রেক্ষাপটে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে আগ্রহী করে তোলে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের। রাশিয়াকে কূটনৈতিকভাবে এক ঘরে করে দেওয়ার যে নীতি অনুসরণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভেস্তে যায় সেই প্ল্যান। ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান ভাবে চীনের যে প্রভাব বাড়ছে, তা মোকাবিলা করতে সাম্প্রতিক সময় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে মনোযোগী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই হয়তো, কোথাও গিয়ে রাশিয়া আর ভারতের ঘনিষ্ঠতা হজম করে নিচ্ছে ওয়াশিংটন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই রুশ এস ৪০০ ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম কিনে নিয়েছিল ভারত। আর যেখানে ঘোর আপত্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তারপর থেকে রাশিয়া আর ভারতের যে দ্বিপক্ষীয় ঘনিষ্ঠতা, তা একপ্রকার উপেক্ষা করে আসছে ওয়াশিংটন। যেন দেখেও দেখছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট, ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমানো। যেখানে ভারতকে অবশ্যই দরকার। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে চীনের হুমকি অথচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারংবার চীনের ক্ষমতা দমানোর চেষ্টা করলেও, পোক্ত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তাই বলা যেতেই পারে, চীনের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পই বলুন, আর জো বাইডেন,পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা হলেও ত্রুটিপূর্ণ। বাইডেনের ক্ষমতার মেয়াদ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত চীনকে ঘাটানোর সাহস পায়নি। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ব্যাপারেও সেভাবে কোন কথা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র খুব দৃঢ়ভাবে নিজের উপর বিশ্বাস রাখে, হয়ত পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে তাদের নেওয়া কৌশল থেকে রাজনৈতিক ভাবে দেশটা লাভবান হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটা হচ্ছে কই? বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোকে নানান হুমকির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে বহু সমালোচকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত এখনো পর্যন্ত একে অপরের নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সেই তুলনায় ভারতের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে রাশিয়া। আর রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক একদমই ভালো নয়। এরই মাঝে ব্রিকস সম্প্রসারণে এক জোটে কাজ করছে ভারত চীন আর রাশিয়া। স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে শুরু হয়ে গিয়েছে হিসাব-নিকাশ।
আর অপরদিকে যদি চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কথা বলা হয়, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ কিন্তু এই দুই প্রতিবেশী দেশের সামনের দাঁড় করিয়েছে দুই ভিন্ন পরিস্থিতি। যার যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করছে রাশিয়া। আপাতত এখন চীনকে কূটনৈতিকভাবে খুব একটা মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের আগে বেজিংয়ের কাছে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল তাইওয়ান প্রণালী। তবে একের পর এক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, সেখান থেকে মনোযোগ সরে গিয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কর্মসূচি জুড়ে একদিকে রাশিয়া আর অন্যদিকে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের অভিযোগ ছিল, চীন রাশিয়া জোটবদ্ধভাবে বিশ্বব্যাপী এক নতুন ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে। এটা আশঙ্কা নয়, কিছুটা ভয়ও বটে। আর সেখানে এবার ভারতের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকায় পশ্চিমা বহু সংবাদ মাধ্যমের কড়া সমালোচনায় মুখে পড়তে হয়েছিল নয়াদিল্লিকে। যার জেরে ভারতের পক্ষে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার একটু কঠিন হয়ে পড়ছে। ওই যে কথায় আছে না, শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়, ঠিক তেমনই বন্ধুর বন্ধু মিত্র হতে পারে। আর এভাবেই একসময়, বিশ্বে রাজ করতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পিঠ থেকে যেতে পারে দেওয়ালে। ভবিষ্যতে ভারত চীন আর রাশিয়ার জোট কতটা মজবুত হবে, ভারতের সঙ্গে চীনের আদৌ সুসম্পর্কে পরিণত হবে কিনা, তার উত্তর তো সময় দেবে। তবে এই সম্ভবনাকে একেবারেই তুরি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আপনি কি বলেন?
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম