।। প্রথম কলকাতা ।।
Alpona Village: গোটা গ্রাম যেন আস্ত একটা ক্যানভাস। গোটা গ্রাম মুড়ে আছে বিচিত্র আলপনায়। বিদেশের মাটিতে নয় নিজের দেশের গ্রাম বাংলাতেই আপনার ভ্রমণ পিপাসা মেটাতে পারেন। এই গ্রামে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন রূপকথার জগতে প্রবেশ করেছেন। এই ছবির রাজ্যে রয়েছে চোখের আরাম, আবার মনেরও শান্তি। গ্রামের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে আপনার খেয়াল থাকবে না আপনি ঠিক কোন দিকে চলেছেন। আসলে তখন যে আপনি গ্রামের মেঠো বাড়ির দেয়ালে আঁকা বিচিত্র আলপনার সৌন্দর্যে তন্ময় হয়ে রয়েছেন। মনে হবে গ্রামের প্রত্যেক মানুষই যেন দক্ষ শিল্পী, যারা তাদের সৌন্দর্য চেতনা এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে বাড়িগুলিতে শিল্পকলা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে যে কোন উৎসব এলেই এই গ্রামে ব্যস্ততা বেড়ে যায় শুধু বড় নয় কচিকাঁচারা পর্যন্ত রঙ তুলে নিয়ে বসে পড়ে। এই নৈসর্গিক পরিবেশ রয়েছে আপনার বাড়ির কাছেই। কলকাতা থেকে পূর্ব বর্ধমান যেতে খুব একটা সময় লাগে না। পূর্ব বর্ধমানের আলপনা গ্রাম বললে আপনাকে যে কেউ চিনি দেবে লবনধার গ্রামের পথ। এই গ্রাম যেন শিল্পীর পটে আঁকা ছবি।
মেঠো পথের দুই ধারে সারি দেওয়া মাটির বাড়ি, দোকান স্কুল মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা কত রঙের চিত্র। একপাল গরু সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। হাঁসের দল জলকেলি করতে ব্যস্ত। কোথাও ধানের বোঝা। মেঠো পথের ধুলো উড়িয়ে খেলা করছে শিশুর দল। ক্যানভাসে নয় আমাদের বাস্তব জীবনেই রয়েছে এই জলজ্যান্ত ছবি। গ্রামের বধুরা যে যার কাজে ব্যস্ত । আলপনার জন্যই এই গ্রামকে অনেকে আলপনা গ্রাম বলে। গ্রামের বাড়ির দেয়ালে আঁকা পাহাড়ি ফুল, পাখি, লতাপাতার হরেক রকমের ছবি আপনার নজর কাড়বেই কাড়বে। শুধু দেশ নয় বিদেশেরও বহু মানুষ এই আলপনা ঢাকা গ্রাম দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন, আবার অনেকেই মন পুষিয়ে তাদের ফটোগ্রাফির সাধ মেটান।
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম দুই নম্বর ব্লকে জঙ্গল ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামে প্রায় ১০০ টির মত বাড়ি রয়েছে। এই গ্রাম ঘিরে রেখেছে শাল সেগুন মহুয়া সহ আরো কত গাছ। গ্রামটির চারিদিকে অন্তত ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত রয়েছে ঘন জঙ্গল। আসলে এই গ্রামের দেয়াল চিত্রগুলি বার্তা দেয় কিভাবে গ্রামের গাছ জঙ্গলকে বাঁচাতে হবে। এই ছবির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে জঙ্গলের পরিবেশ থেকে আদিবাসী সমাজের নিয়ম-কানুন তাদের সংস্কৃতি সহ পৌরাণিক নানান কাহিনী। গাছ কাটলে যে ঠিক কতটা কষ্ট হয় কিংবা পরিবেশের ঠিক কতটা মারাত্মক ক্ষতি হয় তার কাহিনীও পাবেন। আসলে এ শুধু অভিনব সাজ নয়, এর পরতে পরতে রয়েছে জীবনের বেঁচে থাকার নানান বার্তা। এই এখানে জঙ্গল রক্ষার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে লবণধার অন্নপূর্ণা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। এই গ্রামের মানুষ জঙ্গলকে আগলে রাখেন। আসলে যে জঙ্গল তাদের অন্ন জোগায় সেই জঙ্গল তাদের কাছে মায়ের মত। জঙ্গল সংরক্ষণের জন্য তারা গ্রামের বাড়ির দেয়ালে আঁকে নানান ছবি। আসলে এই চিত্র সচেতনতা প্রচারের অংশ। এর পিছনে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন অ্যাসোসিয়েশনের একদল যুবক। কলকাতা থেকে অন্তত ৫০ জন শিল্পী এই গ্রামে গিয়ে আলপনা আঁকার কাজ করেছেন। পরিবেশকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের এই উদ্যোগ সারা ভারত জুড়ে আজ সমাদৃত হচ্ছে। কেউ কখনো ভাবতে পারেননি যে এই পরিকল্পনার ফলে একটা গ্রাম এতটা সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। জঙ্গলে যেভাবে অবাধে গাছ কাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিংবা গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, হয়তো এই সচেতনতার ফলে তা বন্ধ হবে।
আলপনা হল মানব সভ্যতার লোকচিত্রকলা। এই লোকশিল্পকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রধানত গ্রামের মহিলারা। তাদের অঙ্কন শৈলীর মাধ্যমে আলপনায় সাজিয়ে তোলেন নিজেদের বাড়ি গুলি। তবে একটু ব্যতিক্রম লবন্ধার গ্রাম। এখানে প্রথমে ছবি আঁকা শুরু হয়েছে সচেতনতার উদ্দেশ্যে। প্রতিটি দেয়াল বা ঘরের কোনে যেন এক একটি ক্যানভাস। এই ছবি আঁকার কাজ শুরু হয়েছিল গ্রামের অন্নপূর্ণা মন্দির থেকে। এখানে দেয়ালে পাবেন রামায়ণ মহাভারত সহ শ্রী চৈতন্যদেবের কাহিনী। সবুজ ঘেরা অসম্ভব সুন্দর এই ছোট্ট গ্রামে কয়েক ঘন্টার জন্য ঘুরে আসতে পারেন।
গ্রাম বাংলায় দেওয়াল চিত্রের ছবি একেবারেই নতুন নয়। এখনো পর্যন্ত বহু জায়গায় মাটির বাড়ি সাজানো হয় আলপনা দিয়ে। এক্ষেত্রে যে সমস্ত রং ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগটাই প্রাকৃতিক। বর্তমানে যদিও বাজারে নানান রঙের রমরমা। কিন্তু একটা সময় সমস্ত রং গ্রামের ছেলেমেয়েরা নিজের হাতে তৈরি করতেন। যেমন খড়ি মাটি ভিজিয়ে তৈরি করা হত লাল রং, আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে আস্ত সাদা রং। এছাড়াও আলপনা আঁকার রং তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় হতো শুকনো বরই, আমের আঁটির শাঁস চূর্ন, গিরিমাটি, মান কচু ও কলা গাছের আঠার সঙ্গে নানান রঙের মিশ্রণ।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম