।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran-United States relations: ইরানের ক্ষমতা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! আজ পিঠে মারছে ছুরি। আজ যে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের এত ক্ষমতা, এত প্রতিপত্তি, জানেন? একটা সময় ইরানের ক্ষমতা বাড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। শুনতে হয়ত একটু অবাক লাগছে, কিংবা আকাশ থেকে পড়ছেন, কিন্তু এটাই বাস্তব। একটা সময় ছিল যখন যুক্তরাষ্ট্র মনেপ্রাণে চেয়েছিল ইরানের ভালো হোক। শুধু তাই নয়, ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর আজ দুই দেশের সম্পর্ক সাপে নেউলে। শুধুই কি তেল অর্থনীতি, নাকি রয়েছে অন্য কোনও রহস্য? ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র কেন সহ্য করতে পারে না? দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হওয়ার কি আর কোনও সম্ভাবনাই নেই? যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই ইরানকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, নাকি ছিল শুধু স্বার্থের সম্পর্ক? অতীত ইতিহাসে রয়েছে বিস্তর জলঘোলা।
ইরানের শক্তি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! বন্ধুত্ব দেখলে অবাক হবেন
যে দেশ একটা সময় ইরানের শক্তি বাড়িয়েছে, ইরানকে আধুনিক করে তোলার চেষ্টা করেছে, ইরানের শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, আজ সেই দেশটাই মনেপ্রাণে চাইছে ইরান কোনঠাসা হয়ে যাক। এ যেন এক অদ্ভুত ভূরাজনীতি। আসলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমীকরণে কে যে কার বন্ধু, আর কে যে কার শত্রু তা বলা ভীষণ মুশকিল। ১৯৮০ সাল থেকে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্কই নেই। বিশ্ব রাজনীতিতে যখনই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রসঙ্গ আসে, তখনই দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। অথচ এই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ। যেটা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের মধ্য থেকে শেষ নাগাদ। তখন পশ্চিমাদের কাছে ইরান ছিল পারস্য। একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, অপরদিকে রুশ সাম্রাজ্য, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াকে ধীরে ধীরে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে গ্রাস করছিল। স্বাভাবিকভাবেই তখন ইরান জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক বিরোধে। দেশটার নিরাপত্তা নিয়ে ছিল যথেষ্ট অনিশ্চয়তা। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ইরান। আর ঠিক তখন ইরানের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান সেই সময় সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মিত্র শক্তি বলে মনে করত।
শুধু তাই নয়, তৎকালীন সময়ে শাহ সরকারের ট্রেজারার জেনারেল হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয় দুই মার্কিনিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ আর রাশিয়া ইরান আক্রমণ করে। এই দুই পক্ষই তখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল, তাও যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের হাত ছাড়েনি। বরং সম্পর্কটা যাচ্ছিল বেশ ভালোই। জানলে আশ্চর্য হবেন, তখন ব্রিটেন ইরানের মাটিতে উৎপাদিত তেল থেকে মাত্র ১৬% ইরানকে দিত, আর ৮৪% নিজে নিত। ধীরে ধীরে গরীব হতে শুরু করে ইরানের সাধারণ মানুষ। ব্রিটেন ইরানের মানুষকে ভাবত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। অথচ ইরানের মানুষ সেই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারত না। কারণ তৎকালীন ইরানের রাজা ছিলেন স্বয়ং ব্রিটিশদের সমর্থক। যার মাত্রা আরো বেশি পরিমাণে বাড়তে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। উনিশ শতক আর বিশ শতকের প্রথম দিকে যখন ব্রিটিশ আর রাশিয়ান সাম্রাজ্যর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইরানকে একটা শোষিত অবস্থানে ফেলেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বারংবার সেই পরিস্থিতি থেকে টেনে বার করে আনার চেষ্টা করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে লাভের কোন প্রত্যাশা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জন্য কাজ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময় ইরানে প্রায় কয়েক শোর বেশি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। চিকিৎসা এবং সামাজিক কল্যাণেও প্রচুর কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বেসরকারি মিশন।
ইরানের তেলে নজর, সম্পর্ক ভাঙনের সূত্রপাত
হঠাৎ করে ইরানের ফুলেফেঁপে ওঠা তেল সম্পদে নজর পড়তে থাকে পরাশক্তিগুলোর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ইরানের বিশাল তেলের ভাণ্ডার গুলো দখল করতে প্রতিযোগিতায় নামে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন ব্লক আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লক। গোপনে চলতে থাকে গোয়েন্দা গিরি। স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা টের পেয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন ইরানের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। মার্কিন ব্লক যে ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করতে চেয়েছিল সেই নীতি তার পছন্দ হয়নি। তখন থেকেই শুরু হয় আসল ফাটলটা। মোসাদ্দেক হয়ে ওঠেন পরাশক্তিগুলোর চক্ষুশূল। যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ তৎপরতায় ১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তাকে। ক্ষমতায় বসে যুক্তরাষ্ট্রেরই পছন্দের সরকার। ইরানের মানুষ যাকে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার, মোহাম্মদ রেজা শাহ। এনার সময় কিন্তু যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো ইরানের তেল শিল্পে প্রবেশের জন্য একটা অবাধ সুযোগ পেয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তখনও জানা যায়নি, মোসাদ্দেককে কেন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। প্রায় ২০০০ সাল নাগাদ কোথাও কোথাও দাবী করা হয়, সবটাই ছিল নাকি পশ্চিমা পরাশক্তি গুলোর ষড়যন্ত্র। রেজা শাহ আর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলেও ক্রমেই তা অসম হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে রেজা শাহ যুক্তরাষ্ট্রের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।
আর সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র আর ইরান সই করে ফেলে বেসামরিক আণবিক সহযোগিতা চুক্তিতে। ১৯৬৮ সালেও ইরান আণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করে দেয়। তার ঠিক দুই বছর পর, দেশটি বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আণবিক কর্মসূচি চালানোর অনুমতি পায়।সেই সময় ইরানকে আধুনিক করে তুলতে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু তা পছন্দ হয়নি ইরানের বহু মানুষের। যার কারণে ক্ষোভের মুখে পড়েন রেজা শাহ। ইরানের জনগণ ভাগ হয়ে যায় দুই ভাগে। তৈরি হয় একটা বড় ভুল বোঝাবুঝি। মনে করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মদতেই নাকি ইরানের মধ্যে এত গন্ডগোল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্ষোভ আর অসন্তোষ। স্বাভাবিকভাবেই তার একদিন বিস্ফোরণ ঘটে। ইরানের অভ্যন্তরে ১৯৭৯ সালে শুরু হয়ে আন্দোলন। ইরান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন রেজা শাহ। ঠিক তার দুই সপ্তাহ পর নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন ওই আন্দোলনের অন্যতম নেতা, আয়াতুল্লাহু আলি খামেনি।তার নেতৃত্বে ইরানে ঘটেছিল ইসলামী বিপ্লব।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সম্পর্ক কি কোনদিনও জোড়া লাগবে? আশা কতটা?
দুই দেশের তিক্ততা বাড়িয়ে দেয় ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ইরান আর ইরাক যুদ্ধ। ইরাককে নানান ভাবে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ধারণা করা হয়, সেই যুদ্ধে নাকি মারা গিয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। টানা ৮ বছর পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন খামেনি। ১৯৮০ সালে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে থাকা ইরানের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়। এমনকি ইরানের উপর চাপানো হয় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। না, তারপর থেকে আর কখনোই দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। বরং উত্তেজনার পারদ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। একের পর এক চলেছে বাকযুদ্ধ। তবে অল্প বিস্তার বাণিজ্য চললেও ১৯৮৪ সালে ইরানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে দেগে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক তার চার বছর পর, ইরানের একটি যাত্রীবাহী জাহাজে চলে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা। যেটি ইরান থেকে যাচ্ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে। এই ঘটনাটা ছিল অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো। মার্কিনি বাহিনীর যুক্তি ছিল, তারা ওই বিমানটিকে যুদ্ধবিমান ভেবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে।
তারপর থেকে ইরান আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু। ২০১৫ সালে চুক্তির মাধ্যমে ইরান সম্মত হয়েছিল, তার আণবিক কার্যক্রম কমিয়ে দেবে। তার পরিবর্তে ইরানের শর্ত ছিল যে তার উপর থেকে তুলে নিতে হবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই কথা রাখেনি। ১৯১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান। ইরানও একরোখা। মুহূর্তে পাল্টি খায়। নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করেই, ব্যালেন্সটিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান বুঝে গিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার কথা বুঝছে না। তেহরানের স্বার্থের কথা ভাবছে না। তখন ইরানও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ফিরেও তাকাতে চায় না। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটা রীতিমত ফলাও করে ঘোষণা করে দিয়েছে, ২০১৫ সালে আণবিক চুক্তির দ্বারা আরোপিত বিধি নিষেধ তারা মানবে না। ২০২০ তে এসে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি মারা গেলে, চরমে পৌঁছায় দুই দেশের উত্তেজনা। তারপর থেকে আপাতত যা পরিস্থিতি, দেখতেই তো পাচ্ছেন। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার যেন কোনো আশাই যেন আর নেই। উল্টে ইরানকে দাবিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে আণবিক কর্মসূচি। যদি বড় কোন ভূ রাজনৈতিক স্বার্থ না থাকে, তাহলে এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে কোনদিনও হাত মেলাবে না।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম