ভারতের প্রথম মহিলা পপশিল্পী তিনি। তার কেরিয়ারের বয়স পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। দেশ বিদেশের নানা মঞ্চে গান গেয়েছেন তিনি। যার পোশাক-স্টাইল-গান গাওয়ার ভঙ্গী— সবেতেই চমক। এক কথায় এক লিভিং লেজেন্ড হচ্ছেন ঊষা উত্থুপ (Singer Usha Uthup)। হিন্দিতে যাকে বলে ‘হটকে’, ঊষা উত্থুপ ঠিক তাই। তবে গায়িকার কেরিয়ারের প্রথমটা কিন্তু এতটাও সাজানো গোছানো ছিলনা। তার সংগ্রাম কেবল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল না, বরং প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে নিজস্ব ধারা তৈরি করাও ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
শোনা যায়, ছোটবেলায় যার কাছে গান শিখতে গেছিলেন সেই টিচার অবদি দুর ছাই করেছিলেন তাকে। কেন? কারণ তার ঐ খসখসে গানের গলা। সেই শিক্ষিকার মনে হয়েছিল, এই খসখসে গলা নিয়ে আবার গান হয় নাকি? গেট আউট বলে নাকি বের করে দেওয়া হয়েছিল তাকে। সেই শিক্ষিকা সেদিন বুঝতেও পারেননি যে, খসখসে মোটা গলা নিয়েই ঊষা একদিন গোটা ভারত কাঁপাবেন।
আজও কোনও অনুষ্ঠানে ঊষার কোনও গান বাজিয়ে দেখুন, গোটা পরিবেশটাই বদলে যাবে। কই ইহা নাচে নাচে, হরি ওম হরি কিংবা সাত খুন মাফ সিনেমার ও ডার্লিং। ঊষার প্রতিটা গান যেন নতুন। প্রতিটা গানেই এক আলাদাই নেশা। অথচ জেনে অবাক হবেন যে এই গায়িকা একটা সময় নাইটক্লাবেও কাজ করেছেন। বলা ভালো সঙ্গীত জগতে তার যাত্রাটাই শুরু হয়েছিল নাইটক্লাব থেকে। আর একদিন এই নাইটক্লাবেই বদলে যায় তার জীবন। ভাবছেন কীভাবে? বলছি সবটাই।
আসলে খুব ছোট বয়সেই গোটা সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার মাথার উপর। গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু ভারী খসখসে গলার জন্য কেউই সুযোগ দিতে রাজি ছিলনা। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই নাইটক্লাবে কাজ নিয়েছিলেন ঊষা। শাড়ি পরে নাইটক্লাবে গান গাইতেন গায়িকা। এভাবেই একদিন দিল্লির ওবেরয় হোটেলসে অভিনেতা দেব আনন্দের নজর যায় ঊষার উপর। জহুরি যেমন রত্ন খুঁজে আনে। সেভাবেই সেদিন দেব আনন্দের চোখ খুঁজে নিয়েছিল ঊষাকে।
তাঁর হাত ধরেই প্রথম বলিউডে পা রাখেন আমাদের পপ কুইন। তখন তো তিনি নিজেও জানতেন না তিনি ঠিক কী করতে চলেছেন। একপ্রকার ভাগ্যের উপরেই সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। কিন্তু কথায় আছে না, রাখে হরি তো মারে কে? হরিও ঊষার জন্য ভালো কিছুই লিখছিলেন।
বলিউডে আসা মাত্রই সবাই যেন তাকে লুফে নিল। তার তথাকথিত ভারী খসখসে অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠল তার মূল ইউএসপি। একটার পর হিট গান উপহার দিতে থাকলেন দর্শকদের। কিছু গান তো এমন হিট হয় যে তা বিদেশে অবধি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাহুল দেব বর্মণ, বাপ্পি লাহিড়ীর মত তাবড় তাবড় সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
একদিন যে ঊষাকে (Singer Usha Uthup) নিয়ে কেউ কোনও আশাই দেখেনি, সেই ঊষাই গেয়ে ফেললেন হাজার হাজার গান। দীর্ঘ কেরিয়ারে, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু এরকম কত ভাষায় যে গান গেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। এখন তো লোকে বলে ঊষার গলা নাকি ঈশ্বরপ্রদত্ত। কত মানুষ যে এখন তাকে অনুকরণ করে তা আপনি ভাবতেও পারবেন না।
হয়ত অনেকেই জানেননা যে, অমিতাভ বচ্চনের (Amitabh Bachchan) সাথে একটা ছবিতে অভিনয় অবধি করেছেন তিনি। দক্ষিণী ছবি ‘মাম্মুতি’তে দেখা গেছিল তাকে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাথে সাত খুন মাফ ছবিতেও দেখা গেছে ঊষাকে। অনবদ্য প্রতিভার জন্য পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাকে। এছাড়াও পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার, সম্মাননা।
জেনে হয়ত খুশি হবেন যে, দক্ষিণ ভারতীয় হলেও বাংলার প্রতি এক আলাদা টান রয়েছে ঊষা উত্থুপের (Singer Usha Uthup)। সেটা তার ‘ক’ লেখা টিপ দেখলেই বোঝা যায়। কলকাতাকে ভালোবেসেই সেটাকে স্টাইল স্টেটমেন্টে স্থান দিয়েছেন ঊষা।
তবে জানেন এত যশ খ্যাতির পরেও ঊষা কিন্তু ভীষণ ছাপোষা মানুষ। একবার তো অকপটে জানিয়েছিলেন, তিনি যদি গায়িকা না হতেন তাহলে হয়ত তিনি শিক্ষিকা হতেন বা কোনও দর্জির কাজ করতেন। হ্যাঁ এমনটাই আমাদের ঊষা উত্থুপ। ঊষার গল্প আজ অন্যান্য শিল্পীদের জন্যেও প্রেরণা। তার সংগ্রাম কেবল এক গায়িকার সংগ্রাম নয়। বরং একজন নারীর লড়াই, যিনি সমস্ত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে ইতিহাস গড়েছেন।