।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran-Russia: ইসরায়েল আর ইরানের সংঘাতে প্রচুর লাভ রাশিয়ার। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের মোড় ঘুরছে ইরান আর ইসরায়েলের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রকে নাগপাশে বাঁধতে, ইরানই রাশিয়ার শক্ত ঘুঁটি। তলে তলে ইরানকে ঘিরে বড় স্বপ্ন পুতিনের। শুধুই বন্ধুত্ব, নাকি বড় কোন স্বার্থ? মধ্যপ্রাচ্যকে হাতের মুঠোয় রাখতে পুতিনের নয়া প্ল্যান। ইরানের সাথে রাশিয়ার হঠাৎ এত বন্ধুত্ব কেন? পুতিন নিজের বদনাম ঘোচাতে অস্ত্র বানাচ্ছেন ইরানকে! সমালোচক মহলের এত সংশয় আদৌ কি সত্যি?
ইরান রাশিয়ার নতুন জোট, স্বার্থ নাকি বন্ধুত্ব?
যদি বলা হয়, ইরান আর ইসরায়েলের সংঘাতে রাশিয়া খুঁজছে স্বার্থের গন্ধ, তাহলে অনেকেই বিতর্ক খুঁজবেন। আবার কেউ বা খুঁজবেন আসল কারণ। দেখুন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই চলে নিজস্ব নীতিতে এবং নিজেদের স্বার্থে। আর সেই নীতিতেই গড়ে তোলে কূটনৈতিক সম্পর্ক। সেই জায়গা থেকে কিন্তু বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই রাশিয়া। এই যে ইরান আর ইসরায়েলের সংঘাত কিংবা ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সংঘাত, এখানে কিন্তু ইসরায়েলের বিপক্ষে থেকে বড় লাভ করতে চলেছে রাশিয়া। রয়েছে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। রাশিয়ার সঙ্গে হামাসই বলুন, আর ইরান, দুই পক্ষের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। একদিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রতিপত্তি বাড়াতে, ইসরায়েলের পক্ষে থেকে দল ভারী করার চেষ্টা করছে। তখন রাশিয়াও মেতেছে, সেই একই কূটনৈতিক খেলায়।
বহুবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, মস্কো নাকি হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করে, পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেয় হামাস সদস্যদের । যদিও এটা গুঞ্জন হিসেবেই থেকে গিয়েছে, পোক্ত প্রমাণ মেলেনি। তবে এটা ঠিক যে, হামাসের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। রাশিয়া কখনোই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেনি। কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, হয়ত ভ্লাদিমির পুতিন মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত চলছে তার জন্য সরাসরি দায়ী নন। কিন্তু এই সংঘাতের সুফল তিনি কিছুটা পেতে পারেন। সেই ২০২২ এ শুরু হয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। গোটা বিশ্বের নজরও ছিল সেই দিকে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞার বোঝা সামলাতে হচ্ছে রাশিয়াকে। তার উপর সাথে রয়েছে প্রচুর বদনাম। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এখন প্রধান খবর হয়ে উঠেছে ইরান, ইসরায়েল আর হামাস। অর্থাৎ খবরের শিরোনামগুলো রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরে গিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে।
কূটনৈতিক কৌশলে রাশিয়ার হাতিয়ার ইরান
গোটা বিশ্ব জানে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছে পশ্চিমারা। রাশিয়ার কর্মকর্তারা মনে করছে, এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহের একটা বড় অংশ এবার ইউক্রেন নয়, ঘুরে যাবে ইসরায়েলের দিকে। আর সেটাই কিন্তু হচ্ছে। আবার কোন কোন কূটনৈতিক সমালোচকের মতে, এই যে বারংবার রাশিয়া নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠায় ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছে, এই ধারণাটা ভুল। আসলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বাড়াতে ব্যস্ত। শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার যে বড় ভূমিকা থাকবে এটা একটা বিতর্কিত ভাবনা। কারণ রাশিয়া সেই দেশ, যে দেশ বিগত প্রায় দুই বছর ধরে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে, রীতিমত চলছে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ।
আরেকটা বড় কারণ হল, মধ্যপ্রাচ্যের একটা শক্ত ঘুঁটি ইরান। ইরান যদি ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা কৌশলের ক্ষেত্রে রাশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দেশ। বিশেষ করে ইসরায়েলি স্টিলথ ফাইটার জেট কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র গুলি দমন করতে, ইরানিদের কাছে রাশিয়ার উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে। আর এই ফাঁকে, সামরিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত হতে পারে বড় বড় চুক্তি। সেখানেও লাভ রাশিয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার শীর্ষ বিদেশ নীতিতেও অগ্রাধিকার পাচ্ছে ইউক্রেনের যুদ্ধ। কিন্তু তাও মধ্যপ্রাচ্যের ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করতে পারছেন না পুতিন। দিনের পর দিন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে নতুন চুক্তির পরিণতি।
যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বজ্ঞানহীন রাষ্ট্র, রাশিয়ার দাবি সত্যি হলে বড় লাভ!
ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যে যে সংঘাত চলছে তার অবসান কিন্তু অন্যান্য উপায়ে এই অঞ্চলে আরো শক্তিশালী করতে পারে রাশিয়ার প্রভাবকে। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের মনে গেঁথে যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা রাষ্ট্র। সেখানেও আখেরে লাভ পুতিনেরই। কারণ গাজা যুদ্ধ চলছে প্রায় সাত মাস ধরে। এই নিরাপত্তাহীনতা অঞ্চলের মানুষের কাছে আরও শক্তিশালী করছে রাশিয়ার বার্তা। বার্তাটা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এই অঞ্চলে গিয়ে সঠিকভাবে ব্যালেন্স করতে পারছে না। এমত পরিস্থিতিতে যখনই মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি ঝুঁকছে, অপরদিকে কিন্তু ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ কমছে। রাশিয়া হয়ত এটাই চাইছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা, ইউক্রেনে মার্কিন সমর্থনের ভবিষ্যৎকে ফেলে দিয়েছে সন্দেহের মধ্যে। আর সেই সুযোগে রাশিয়া ইউক্রেনে বহু অঞ্চলে আরো জোরদার করেছে হামলা। ইরানের ইব্রাহিম রাইসি আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে একটা অভিন্ন বিষয় ছিল। উভয়ই ব্যক্তিগতভাবে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে। দুজনে এই গাজার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে মিলিত হয়েছিলেন রাশিয়ার ক্রেমলিনে।
যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন, একটা সময় রাশিয়া ইরান কিংবা চীনের মধ্যে এতটাও বন্ধুত্ব ছিল না। এরা ভিতরে ভিতরে সাম্রাজ্যবাদী। একটা সময় পরস্পরের প্রতিবেশী দেশগুলোয় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এশিয়ার বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি করত। কিন্তু সবকিছুর পাশা পাল্টে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ আর কর্মকাণ্ডে এই দেশ গুলোই জোট বাঁধছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। একটা সময়ে ইরান ইসরায়েল আর রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। আজ যে, ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার অনেকটা তিক্ততা ভাব, বছর ছয় আগে এমনটা ছিল না। মস্কোর সঙ্গে ইসরায়েলের বেশ ভালই ঘনিষ্ঠতা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় স্মরণে মস্কোতে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজের বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন নেতানিয়াহু। পুতিন সেই সময় ভারসাম্যের চেষ্টা করছিল, ইরান আর ইসরায়েলের সঙ্গে। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটা বিমান ঘাঁটি রয়েছে, যেখান থেকে শক্তিশালী রাডার আর ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে সহজেই ইরানের মিত্র হিসেবে ইসরায়েলের বিমান তৎপরতা বাধা দিতে পারতো। কিন্তু রাশিয়া সেই সময় এমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সিরিয়া আর লেবাননের উপর হামলার জন্য ইসরায়েলের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল আকাশপথেকে। তবে রাশিয়া আর ইরানকে অনেকটা কাছাকাছি এনেছে সিরিয়া যুদ্ধ ।
এখন রাশিয়া, ইরান, চীন, এই তিন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রায় একই। গড়ে তুলতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যহীন একটা বিশ্ব ব্যবস্থা। আরো দৃঢ় করতে চায় নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক বন্ধনকে। যেখানে লাভ ওই তিন রাষ্ট্রের। ২০২২ সাল থেকে ইরান রাশিয়াকে ড্রোন আর অস্ত্র সরবরাহ করছে, যে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে ইউক্রেনে। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়াকে ট্যাঙ্কার যোগে ইরান পাঠিয়েছিল প্রায় দশ লক্ষ ব্যারেল তেল। ইরান আর রাশিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় প্রচুর ভিন্নতা রয়েছে। তারপরেও নিজেদের কূটনৈতিক স্বার্থে হাত মিলিয়েছে দুই দেশ। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, পারমানবিক চুক্তি কিংবা চীনের ভূমিকার মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই রাষ্ট্রের মতামত ভিন্ন। যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে থাকা পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন, তখন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, এই সিদ্ধান্তে নাকি বেশ খুশি রাশিয়া। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের জোট যদি ভাঙা যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে জয় হবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির। মস্কো যুক্তরাষ্ট্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে, একটা অনির্ভরযোগ্য রাষ্ট্র হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যেমন সিরিয়া, লিবিয়া, তুরস্কের মতো দেশ গুলো নীতি গ্রহণ করবে তাদের নিজের মতো করে। আর সেই জায়গায় মধ্যপ্রাচ্যের মাটি হারাবে ওয়াশিংটন, অপরদিকে ক্ষমতা বাড়বে মস্কোর।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম