।। প্রথম কলকাতা ।।
Panam City in Bangladesh: বিশাল বড় একটা শহর, যেখানে শুধু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় নিঃসঙ্গ অট্টালিকা কিন্তু এখানে কোন মানুষ বাস করে না। এই ভূতের শহরে গেলে একটু গা ছমছম করবে। দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় অট্টালিকা গুলো ঝলমল করলেও নিশুতি রাতে গোটা শহর ঢাকা পড়ে নিকষ কালো অন্ধকারে। তাই একে বলা হয় ভুতুড়ে নগর বা অন্ধকার নগর। এই অন্ধকার নগর আবার দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই ভূতের শহর দেখতে আসেন। বাংলাদেশের(Bangladesh) মানুষদের কাছে এই ভূতের শহর অর্থাৎ পানাম(Panam) নগর অত্যন্ত গর্বের বিষয়। পানাম নগরকে বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় অট্টালিকা, খসে পড়ছে ইঁট। এই ভুতুড়ে শহর ছিল বাংলার রাজধানী। ১৫ শতকে ইসা খাঁ সোনারগাঁওতে পানাম নগরীতে স্থাপন করেছিলেন ঐতিহ্যবাহী এক রাজধানী। যা সবসময় মানুষের কোলাহলে মুখরিত থাকত। এই শহরের রাস্তায় ছিল প্রচন্ড ব্যস্ততা। বিদেশ থেকে জিনিস এনে কেনাবেচা চলত। দেশের মসলিম আর বিলাতি থান কাপড়ের রমরমিয়ে চলত বাজার। সেই সময় গোটা ইউরোপের কাছে এই বাজার বেশ জনপ্রিয় ওঠে। আজ সেই শহর পড়ে রয়েছে এক রাশ শূন্যতা নিয়ে। পরবর্তীকালে যেসব মানুষরা এই শহরে বাস করতেন তারা ভূতের ভয়ে নাকি শহর ছেড়ে চলে যান। এমনটা দাবি করেন অনেকেই। পানামের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ভুতুড়ে শহরের তকমা।
পানামা শহরে ঢুকলেই যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন তখন দুপাশে দেখতে পাবেন সার বাধা অট্টালিকা। সবগুলো তৈরি হয়েছে ইউরোপীয় আর বাঙালির শিল্পরীতির মিশেলে। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৫২ টি অট্টালিক। শহর ফুঁড়ে মাঝবরাবর দিয়ে চলেছে একটি মাত্র রাস্তা। শহরের উত্তর দিকে রয়েছে ৩১ টি অট্টালিকা, দক্ষিণ দিকে ২১ টি অট্টালিকা। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে বিশ্বের প্রায় ১০০ টি ধ্বংসাবশেষ ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায় সাগৌরবে জায়গা করে নিয়েছে পানাম নগরী। যদি নির্মাণশৈলী কিংবা নান্দনিকতার কথা বলা হয় তাহলে এই শহর বহু এগিয়ে। বড় বড় অট্টালিকার সূক্ষ্মকাজ আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। অট্টালিকার মধ্যে কি নেই! পাকঘর , দরবার হল, স্নানের ঘর, নাচের ঘর, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির সহ আরো অনেক কিছু। পানাম নগরীতে গেলে উপরি পাওনা হিসেবে পাবেন বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর। এটি রয়েছে পানাম থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে।
এই শহরটিতে দোতলা এবং একতলা বাড়ি প্রচুর। মূলত সেই সময় বাংলার ধনীর ব্যবসায়ীরা এখানে বাস করতেন। ব্যবসা চলতো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই পরবর্তীকালে এই নগর করে তোলে। এখানে ইউরোপীয় এবং বাংলা শিল্পকলা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন পাবেন। মেঝেতে রয়েছে দুর্দান্ত লাল সাদা কালো মোজাইকের কারুকাজ। এই ভুতুড়ে শহরে প্রবেশ করলে মনে হবে এখানে যেন কোনো খুঁত নেই। মানুষ বসবাসের জন্য উত্তম জায়গা। জল সরবরাহের জন্য শহরের পাশ থেকে বয়ে গেছে দুটি খাল। এছাড়াও ভেতরে রয়েছে পুকুর। প্রত্যেক বাড়িতে রয়েছে একটা করে কুয়া। দুটো বাড়ির দূরত্ব নির্দিষ্ট। পাশাপাশি নগরীর আশেপাশে রয়েছে ইসা খাঁ আর তার ছেলের জন্য প্রমোদ ভবন, পঞ্চ পীরের মাজার, সোনাকান্দা দুর্গ, ফতেহ শাহের মসজিদসহ প্রচুর পুরাতাত্বিক স্থাপনা। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরের সব কিছুই অটুট থাকত। কিন্তু নীলকুঠি এসে সব তছনছ করে দিয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের নীল চাষের জন্য বেছে নেয় পানামকে। সেখানেই তৈরি করে নীলকুঠি।
মসলিন বস্ত্র ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় নীল ব্যবসা কেন্দ্র। যদিও শেষমেষ সেই নীলকুঠিও টিকে থাকতে পারেনি। নতুন করে সংস্কারের পলেস্তারার নিচে চাপা পড়েছে নীলকুঠির মূল রূপ। ব্রিটিশরা দেশ ত্যাগ করলে এখানে ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তিও কমতে থাকে। ব্যবসায়ীরা এই শহর ত্যাগ করলে নিঃসঙ্গ একাকীত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অট্টালিকাগুলো। আশেপাশে এলাকা থেকে বহু মানুষ এই অট্টালিকা দখল করলেও ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এই নগর দখল মুক্ত করা হয়। ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই অট্টালিকাগুলি দশ থেকে পনেরো বছরের জন্য ইাজারা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অযত্নে তা নষ্ট হতে থাকে। যার কারণে ইজারা আর নবায়ন করা হয়নি। পানামার কাছ থেকে বয়ে গিয়েছে পঙ্খীরাজ খাল, তার উপর ১৭ শতকে তৈরি হয়েছিল একটি পুল, যা আমিনপুর ও দুলালপুর গ্রামের মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছে। সেই পানাম আর নেই, দেওয়ালে গজিয়েছে গাছপালা। দেওয়াল ফুঁড়ে পৌঁছে গিয়েছে গাছের শিকড়। চুরি হয়ে গিয়েছে বহু অট্টালিকার কড়ি কাঠ তক্তা, কোনো কোনো বাড়ির ছাদ ধসে পড়েছে।
আপনি যদি একটু রোমাঞ্চক বা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হন তাহলে এই শহর থেকে ঘুরে আসতে পারেন। বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকার একদম কাছেই রয়েছে পানাম। ঢাকা থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটার পূর্বে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এখান থেকে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা হয়ে উত্তর দিকে গেলে পেয়ে যাবেন পর্যটন নগরী সোনারগাঁও। ঢাকা থেকে বাস কিংবা কোনো প্রাইভেট গাড়িতে করে এখানে পৌঁছাতে পারবেন।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম