।। প্রথম কলকাতা ।।
স্বাধীনতার জন্য খুন করেছেন নিজের স্বামীকে। নিজের হাতে মুছেছেন সিঁথির সিঁদুর। প্রাণ বাঁচিয়েছেন নেতাজির। ভারতের এই সাহসী নারী নীরা আর্য। এনার সম্পর্কে যতই বলবেন ততই যেন কম। পেয়েছিলেন কালাপানির সাজা। উপড়ে নেওয়া হয়েছিল স্তন। পাশবিক অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া হয়েছিল সারা শরীর। স্বাধীন ভারত কি নীরা আর্যকে মনে রেখেছে?
জন্ম সচ্ছল পরিবারের। বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। চাইলেই আরামে বিলাসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু না, বাংলা হিন্দি ইংরেজি জানা ডাকাবুকো এই মেয়ে নিয়েছিলেন দেশের দায়িত্ব। বাবার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করলেও, সংসারে মন টেঁকেনি। স্বামী ছিলেন ইংরেজদের গোলাম, যা কিছুতেই নীরার সহ্য হচ্ছিল না। যোগ দেন আজাদ হিন্দ ফৌজের শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগে। ছেলেদের মতো চুল ছেঁটে, পোশাক পরে নানান কাজের আছিলায় ব্রিটিশ সেনা শিবির থেকে শুরু করে ঢুকে যেতেন অফিসারদের বাড়িতে। গোপন তথ্য পাঠাতেন নেতাজির কাছে। পরিকল্পনা ছিল, ধরা পড়লেই নথিগুলো পুড়িয়ে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যা করবেন।
নীরার স্বামী ছিলেন ইংরেজদের অনুগত। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুকে লক্ষ্য করে গুলি চালান, কিন্তু গুলি লাগে নেতাজির দেহরক্ষীর গায়ে। ঠিক সেই সময় নীরা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বামীর উপর। স্বামীকে হত্যা করে বাঁচান নেতাজির। আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মসমর্পণের পর অধিকাংশ সৈন্যকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ অফিসার স্বামীকে হত্যার জন্য নীরাকে দেওয়া হয় কালাপানি সাজা।
আত্মজীবনীতে তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা শুনলে শিউরে উঠবেন। কলকাতা জেল থেকে যখন আন্দামান জেলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন থাকার জায়গা বলতে ছোট্ট একটা সেল। রাত দশটায় পর্যন্ত তাঁর কাছে এসে পৌঁছায়নি কোন মাদুর বা কম্বল। শক্ত ঠান্ডা মাটিতেই শুয়ে পড়েছিলেন। রাত বারোটায় প্রহরী তাঁর গায়ে কম্বল ছুঁড়ে মারেন। সকালে খেতে হয়েছে গরম ফুটন্ত খিচুড়ি। তারপর এল কামার। হাতের শিকল কাটতে গিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে কেটে ফেলল নীরার হাতের চামড়া। পা থেকে বেরি কাটার সময় হাতুড়ি দিয়ে মারতে থাকল নীরার পায়ে। রেগে গিয়ে নীরা বলেছিলেন, “তুমি কি অন্ধ?” উত্তরটা এসেছিল “দরকার পড়লে তোমার বুকেও মারব”। একরাশ ঘৃণা নিয়ে থুথু ছুঁড়ে দিয়ে নীরা বলেছিলেন, “নারীকে সম্মান করতে শিখুন”। তখন জেলার জানায়, নেতাজির হদিস দিলে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হবে। সেদিন মুখ খোলেননি নীরা। পরিণামে অনেকটা সাঁড়াশির মত দেখতে ‘ব্রেস্ট রিপার’ দিয়ে উপরে ফেলা হয় নীরার ডান স্তন। রক্তাক্ত নীরা তখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এখানেই শেষ নয়, অমানবিক পাশবিক অত্যাচারে সারা শরীরে হয়ে গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু স্বপ্ন ছিল একটাই, স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি নতুন সূর্যোদয় দেখবেন।
সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, জেল থেকে মুক্তিও পান। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগের সম্মান কি পেয়েছেন? স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর কয়েকটা ছবি ছাড়া লড়াইয়ের গল্প সেভাবে পাবেন না। শেষ জীবনটা কেটেছে বড্ড অভিমানে। নীরা হারিয়ে গিয়েছিলেন সাধারণের ভিড়ে। শোনা যায়, তিনি নাকি ফুল বিক্রি করে জীবন চালিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা খাতায় কলমে নয়, এসেছিল লক্ষ লক্ষ বিপ্লবীর আত্মত্যাগের পরিবর্তে। সেই তালিকায় নীরা ছিলেন মহান দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী গুপ্তচর, সংবেদনশীল লেখক, দায়িত্বশীল নাগরিক, সাহসী এবং আত্মমর্যাদাশীল নারী।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম