।।প্রথম কলকাতা।।
Iran And Pakistan Conflict: যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ফাটল ধরতে পারে ইরান আর পাকিস্তানের সম্পর্কে? ইরান পাকিস্তানকে টেনে নিয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক আদালতে। কি এমন গুরুতর বিষয়? যার কারণে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লেগেও আবার ভাঙার পথে? একটা চুক্তি করতে, পাকিস্তান আর ইরানের দশকের পর দশক কেটে যাবে না তো। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের মাঝে ব্যালেন্স করতে গিয়ে তাহলে কি বেসামাল হয়ে পড়ছে? ইসলামাবাদ এখন কাকে সামলাবে? ইরান নাকি যুক্তরাষ্ট্র? তেল পাইপ চুক্তি নিয়ে তেহেরান আর ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে মনকষাকষি শুরু হয়ে গেলেই কিন্তু বিপদ। হঠাৎ কেন এমন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে? কিছুদিন আগেই তো পাকিস্তান ঘুরে গেলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। যা অত্যন্ত ভালো খবর বলেই মনে করেছিল পাকিস্তান। দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে, ধিকে ধিকে এগোচ্ছে উন্নতির দিকে। তাহলে আবার নতুন করে অশনি সংকেতটা কীসের? ইরান আর পাকিস্তানের মধ্যে তেল পাইপ চুক্তি নিয়ে এত টালবাহানা কেন? যুক্তরাষ্ট্রই বা কেন এই চুক্তি কার্যকর হতে দিতে চাইছে না? তাহলে কি ইরান-পাকিস্তানের জোটের কাছে ভয় পাচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া? কি আছে এই চুক্তিতে? যা বদলে দিতে পারে বিশ্ব রাজনীতি।
এই তো কিছু মাস আগের কথা। যখন ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে হামলা চালিয়েছিল সরাসরি পাকিস্তানের মাটিতে। সেই আক্রমণ ঘিরে কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কম টানাপোড়েন তৈরি হয়নি। জবাবে পাকিস্তানও ইরানে পাল্টা হামলা চালায়। তবে হ্যাঁ, এই পাল্টা হামলার পরেও কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক ভাঙন ধরতে ধরতে গিয়েও বেঁচে গিয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে, ছেদ পড়েছে পুরনো শত্রুতায়। পুনরায় কথা হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে হওয়া গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি নিয়ে। চুক্তি বলুন আর মেগা প্রকল্প , এটা নিয়ে এখন কথা হলেও এটা বহু পুরনো চুক্তি। এই প্রকল্পের কথা ভাবা হয়েছিল ১৯৯০ দশকে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর আমলে। তার আগে কিন্তু এই প্রকল্পটি ছিল ইরান পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে একটা গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প। নিরাপত্তা জনিত কারণ দেখিয়ে ভারত এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ পাকিস্তান যেকোনো মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে এই তেল পাইপ লাইনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। তারপর থেকে এই প্রকল্প ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প হিসেবে থেকে যায়।
এই প্রকল্পে ইরান আর পাকিস্তানের মধ্যে কাজ শুরু হয় ২০০০ সাল নাগাদ। ২০১৩ সালে ইরান সফরে গিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি যার উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে ১০টা বছর কেটে গিয়েছে, প্রকল্প নিয়ে কোন কাজই হয়নি। ২০১৩ সাল নাগাদ কিন্তু ইরান এই পাইপ লাইনের বেশিরভাগ অংশ তৈরি করে ফেলেছিল। কিন্তু বাকি ছিল পাকিস্তান সীমান্ত থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার এলাকার কাজ। বহু সমালোচক অভিযোগ করে বলেন, পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের আমলে এই প্রকল্পের বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। পরে শাহবাজ শরীফ ক্ষমতায় এলে প্রকল্পের জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে একটি কমিটি গঠন করেন। প্রায় এক বছর পর জ্বালানি বিষয়ে ক্যাবিনেট কমিটি এই প্রকল্পের একটা অংশের অনুমোদন দেয়।
তবে কেন এতদিন ধরে ঝুলে ছিল চুক্তিটা? সেক্ষেত্রে কূটনৈতিক মহলের একাংশ আঙুল তোলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সমালোচক মহলের মতে, সেই সময় পাকিস্তানি সরকার চাইছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে। তার উপর, যেহেতু ইরানে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই ইরান থেকে তেল আর গ্যাস রপ্তানির উপরেও ছিল একগুচ্ছ বাধা। এই প্রকল্পে যে সংস্থা কাজ করবে সেই সংস্থাও কিন্তু পড়তে পারে নিষেধাজ্ঞার কবলে। তবে বর্তমানে বিষয়টা দাঁড়িয়েছে আরও জটিল রূপে। কারণ এই গ্যাস প্রকল্পটার বিষয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যার কারণ হিসেবে জানানো হয়েছিল, ইরানের উপর থাকা একাধিক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। এখন পাকিস্তানের অবস্থা হয়েছে অনেকটা শাখে করাতের মত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যে গভীর সম্পর্ক তা তো জানেনই । পাকিস্তানকে এখন ব্যালেন্স করতে হচ্ছে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। আবার ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের ঘোর শত্রু। পাকিস্তান না পারছে যুক্তরাষ্ট্রের কথা সম্পূর্ণভাবে ফেলে দিতে, আবার না পারছে ইরানের সাথে হওয়া প্রকল্পটাকে বাতিল করতে। কারণ এই প্রকল্পে কাজ না করার জন্য ইরান আন্তর্জাতিক সংস্থা মারফত পাকিস্তানের উপর সম্ভাব্য মোটা জরিমানা বসাতে পারে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানকে টেনে নিয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক আদালতের দোরগোড়া পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই ইরান প্রচুর টাকা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। শুধুমাত্র পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের কারণে প্রচুর লস খেতে হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটাকে। ইরানের অভিযোগে জরিমানা হতে পারে পাকিস্তানের। কূটনৈতিক মহলের দাবি আপাতত এই জটিলতা এড়াতে পাকিস্তান পাইপ লাইন বসানোর অনুমতি দিয়েছে। যদিও এগুলো সবই সম্ভবনা, এখনো পর্যন্ত ইরানের তরফ থেকে এই বিষয়ে কোন আল্টিমেটাম দেয়া হয়নি।
আসলে ২০১৩ সালে সই হওয়া এই প্রকল্পে পাকিস্তানের অংশের কাজ ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, যদি এই প্রকল্প থেকে পাকিস্তান সরে যায় তাহলে ইরানকে দিতে হবে প্রায় ১৮০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ। প্রায় ১৯০০ কিলোমিটার এই পাইপ লাইন পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা মেটাতে ২৫ বছর ধরে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করবে। ইরানের দক্ষিণে ফারস গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান সিন্ধু পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল এটা নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে উদ্যোগ নিতে চলেছে পাকিস্তান। যদিও পাকিস্তানের যুক্তি, পাইপলাইনটি আন্তর্জাতিক বিধি নিষেদের আওতায় এখনো আসেনি এবং ইরান আর পাকিস্তান দুই দেশী এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছে। ওদিকে ইরান যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সম্পর্কে একদম চুপ ইসলামাবাদ। পাকিস্তানি শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক সম্মেলনে দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তি নিয়ে কথা বললেও ইরান যে আইনি ব্যবস্থা নিয়েও নিতে পারে এই সম্পর্কে কোন কথা আপাতত বলছে না। আসলে কি বলুন তো, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে শুরু করে শিল্প কলকারখানায় প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু দ্রুত পাকিস্তানে নিজস্ব মজুদ হ্রাস পাচ্ছে এবং উচ্চ মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে এলএনজি সরবরাহ ব্যয়বহুল উঠেছে, তাই এই মুহূর্তে সস্তা গ্যাস ভীষণ দরকার। বলা হয়ে থাকে, ইরানি রয়েছে বিশ্বের অন্যতম গ্যাসের মজুদ। কিন্তু পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অশান্তি আর উৎপাদন বিলম্বে ইরানের সেই বিকাশকে আরো ধীরে করে দিয়েছে।
আপাতত এই চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান এখন ভাবছে নিজের স্বার্থের কথা। বন্ধুত্বের আগে গুরুত্ব দিচ্ছে নিজের স্বার্থকে। সম্প্রতি ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটার উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, পাকিস্তান কি করবে, কখন করবে আর কিভাবে করবে, যাই হোক না কেন সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ বা কেন বলবে? এখানে পাকিস্তান নিজের স্বার্থ দেখবে। নিজেদের প্রতিশ্রুতি দেখবে। পাকিস্তান সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পাকিস্তানের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। সেটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পাকিস্তান কাউকে ভেটো ব্যবহার করতে দেবে না। আরো বলেন, সম্প্রতি ইরানের প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান সফর খুবই ফলপ্রসু ছিল। আন্তর্জাতিক মহলের গুঞ্জন বলছে, এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমঞ্চে ইরানকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন দেখতে চেয়েছি সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তান আর ইরান তাদের বাণিজ্য দুই বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে দশ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সম্মত হয়েছে।