।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran-India: ইরান মুক্তি দিল ভারতীয় নাবিকদের। কিন্তু কোন যুক্তিতে? কূটনৈতিক কৌশলে ভারতের বাজিমাত। ভারতের কাছে ইরান আগে নাকি, ইসরায়েল? ভারত আর ইরানের যেন মাখো মাখো ভাব। যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু টলাতে পারছে না দুই দেশের সম্পর্কের ভিত। বন্ধুত্বের কোন নীতিতে চলছে ভারত আর ইরান? একদিকে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র, আরেকদিকে ইরান, এই দুইয়ের মাঝে কীভাবে ব্যালেন্স করছে নয়া দিল্লি? ইরান ভারতকে এত গুরুত্ব দেয় কেন? দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা জানলে হাঁ হয়ে যাবেন, বুঝতে পারবেন কেন তেহেরান আর নয়া দিল্লি একে অপরকে এতটা সম্মান করে।
ভারতীয় নাবিকদের মুক্তি দিল ইরান
ভারতের পাঁচ বন্দী নাবিককে ফেরালো ইরান। সবাই বলছে এটা নরেন্দ্র মোদির কূটনীতির জোর। ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের বিন্দুমাত্র আঁচ পড়েনি ভারত আর ইরানের সম্পর্কে। গত ১৩ই এপ্রিল দুবাইয়ের উপকূলে ইসরায়েলের একটা কার্গো জাহাজ আটক করেছিল ইরানের ইসলামিক রেভেলিউশনারি গার্ড কর্পস। গত এপ্রিল মাস থেকে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের মেঘ। এমত পরিস্থিতিতে হরমুজ প্রণালীতে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে, ওই জাহাজ আটক করেছিল তেহরান। যেখানে ২৫ নাবিক এর মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন ভারতীয়। যার মধ্যে ছিলেন একজন মহিলা নাবিক। আটক হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যেই ভারতীয় ওই মহিলা নাবিককে মুক্তি দেয় ইরান। দেশে ফিরে ওই মহিলা নাবিক জানান, বন্দি থাকলেও ভারতীয় নাবিকদের নাকি কোন অসুবিধাই হয়নি। আটকে পড়া বাকি ১৬ জন নাবিককেও খুব দ্রুত মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি দেশে ফিরলেও বাকিরা এতদিন আটক ছিলেন। তবে ইরান বহু আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল, কেবল ভারতীয় নয় অন্য নাবিকরাও খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবে। দেরি না করে দ্রুত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ফোন করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদোল্লাহিয়ানকে। ভারতের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার জন্য ইরান কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। ইরানের অর্থমন্ত্রীও জানিয়েছেন, মানবিক দিক থেকে বিচার করে ওই জাহাজে আটক নাবিকদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেহরান। প্রথমে ভারতীয় মহিলা নারীকে দেশে পাঠানো হলেও, বাকিদের মুক্তি নিয়ে শুরু হয়ে যায় কূটনৈতিক টানাপোড়েন। বহু আলোচনার পরে দেখা মিলল আশার আলো। নথি সংক্রান্ত কাজকর্ম এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর, মুক্তি পেল ভারতের পাঁচ নাবিক। কূটনৈতিক মহলের মতে, ভারতের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ এক সম্পর্ক রয়েছে, তাই ভারতীয় নাবিকদের প্রথম থেকেই সাহায্য করেছে ইরানের প্রশাসন। আর এই বিষয়টাকেই ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
ভারত ইরানের সম্পর্ক এত গভীর কেন?
যদি বলেন, ভারত আর ইরানের সম্পর্কটা ঠিক কতটা গভীর? না, এই প্রশ্নের উত্তরটা কয়েকটা শব্দে বলা যাবে না। বছর চারেক আগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তৎকালীন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি পালন করে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছরের পূর্তি উৎসব। সেই সময় দিল্লি আর তেহেরানের যে গলায় গলায় ভাবছিল, এখনো কিন্তু তা রয়েছে। তবে ইরান আর ভারত, এই দুই দেশের সম্পর্ক দুই তরফ থেকেই টিকিয়ে রাখা কিন্তু মুখের কথা নয়। কারণ একটাই, দুই দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো একে অপরের শত্রুপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মিত্র রাষ্ট্র, কিন্তু তার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ভারত ইরানের সাথে ব্যালেন্সের করে বজায় রেখেছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। অপরদিকে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র বলুন, আর ইসরায়েল বলুন, এই দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক একদমই ভালো নয়। একটা সময় কূটনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করত, ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতের আবহে তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরো নিবিড় করার সিদ্ধান্ত কিংবা তা প্রচার করা, ভারতের জন্য যথেষ্ট চাপের। ইরানের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে নয়া দিল্লিকে হাঁটতে হচ্ছে একটা সরু তারের উপর দিয়ে। ভারতকে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আর বাণিজ্যিক যোগাযোগ বজায় রাখতে হচ্ছে, পাশাপাশি ইরানকেও পাশে রাখা বড্ড দরকার। কারণ ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে আফগানিস্তান তথা পশ্চিম এশিয়ার বৃহৎ বাজারে প্রবেশ করেছে ভারত। চাবাহার বন্দর ব্যবহার নিয়েও কিন্তু ভারতের প্রতি যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে ইরানের। আসলে দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতার মূল সিক্রেট হল, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জোর।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী ইরান
এই তো গত বছরের কথা, ইরান নিজে থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো উন্নত করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। সেই সময় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে রীতিমত বৈঠক করেন ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। দুই দেশের অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যেই সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয় ইরান। এমনকি ইরানের সুখ দুঃখের অংশীদারও হয়েছে নয়া দিল্লি। চলতি বছরের একদম শুরুর দিকে যখন ইরানে জোড়া বিস্ফোরণ ঘটে, তখন সেই সংকটে তেহেরানর পাশে থাকার বার্তা দিয়েছিল ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। আসলে কি বলুন তো, দুই দেশের কূটনৈতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যেহেতু বহুদিনের, তাই সেই জায়গা থেকে ভারত কিংবা ইরান উভয়পক্ষ একটা আদর্শ নীতি মেনে চলে। যদি অপরিশোধিত তেল আমদানির কথা বলি, তাহলে একসময় ইরান ছিল ভারতের শীর্ষ তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেই আমদানি কমিয়ে নয়া দিল্লি বাধ্য হয়েছিল বিকল্প উৎস খুঁজতে। তবে হ্যাঁ, সাউথ ব্লকের কাছে ইরান প্রসঙ্গ অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। কারণ ইরানের চক্ষুশূল ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক সবাই জানে। কয়েক মাস আগে যখন ইরান আর ইসরায়েল নতুন করে সংঘাতে জড়িয়েছে, তখন প্রশ্ন উঠেছিল, ভারত কোন পক্ষ নেবে? এই প্রশ্নে নাকি নয়া দিল্লি বেশ উদ্বিগ্ন। তবে ভারত এখনো পর্যন্ত দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া কিংবা না নেওয়ার বিষয়ে কোনো বড়সড় নীতিগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ইরান ইসরায়েলের সংঘাতে ভারত কী চায়?
ভারত আর ইরানের সম্পর্ক বেশ পুরনো। সেই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, দুই দেশই সেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরেও কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। নিষেধাজ্ঞার কারণে, ইরান থেকে ভারত তেল কিনতে না পারলেও, টলানো যায়নি দুই দেশের সম্পর্ক। উপরন্তু ২০২২ সালে দুই দেশ প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ইরানে রয়েছে ভারতের বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ। ২০১৮ সাল নাগাদ চাবাহার বন্দরসহ দুই দেশের মধ্যে প্রায় নটি চুক্তি একসাথে স্বাক্ষরিত হয়। যে তালিকায় রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, শক্তি , যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়তার মতো বিষয়গুলি। এমনকি ভিসা নীতি সরলতার করতেও দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে চুক্তি। সত্যি বলতে, ভারতের সামনে এখন ‘বিকশিত ২০৪৭’ এর লক্ষ্য। যেখানে ভারত নিজেকে প্রকাশ করতে চায় বিশ্বমিত্র হিসেবে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ইরান আর ইসরায়েলের সংঘাতে ভারতের কাছে একটু অস্বস্তিকর হয়তো হতে পারে, কিন্তু ভারত কখনই চায় না ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ হোক। উপরন্তু দুই বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতা করতেও রাজি নয়া দিল্লি।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম