।। প্রথম কলকাতা ।।
India-Iran Relationship: ইরানের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিটা ঠিক কেমন? বন্ধুত্বের নাকি শত্রুতার? ইরানের সাথে ভারতের বড় চুক্তি। দেখে শিখছে পাকিস্তান। পাত্তা পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। তেহরান পাকিস্তানের থেকে কেন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভারতকে? ব্যাপারটা কী? দিল্লির সাথে তেহরানের মাখোমাখো সম্পর্ক ভেস্তে দিচ্ছে চীনের বড় প্ল্যান। ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের মাঝে, কীভাবে ব্যালেন্স করছে ভারত? ইরানের চাবাহার আসল জ্যাকপট। কী আছে এখানে? ইরান ভারতের সম্পর্ক দেখে শিক্ষা নিচ্ছে অন্য দেশগুলো। তাহলে ভারতীয় জাহাজে হুথি হামলায় কেন চুপ ইরান? এবার বেরিয়ে এলো আসল কারণ। ভারতের নির্বাচন মিটলেই, ফাইনাল ইরানের সাথে বড় ডিল।
একটা সোজা হিসাব শুনুন। ইরান ভারতের জন্য ঠিক কতটা ইম্পরট্যান্ট একটা রাষ্ট্র, বুঝতে পারবেন। ইরানের দক্ষিণ দিকে রয়েছে চাবাহার বন্দর। যে বন্দর নিয়ে ভারত আর ইরানের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলছে আলোচনা। এই একটা বন্দর আরো দৃঢ় করতে পারে ভারত-ইরান সম্পর্ক । বন্দরটি রয়েছে ওমান উপসাগরের একদম মুখে, আর এটাই ইরানের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। ইরানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরেছে এই চাবাহার। অবস্থান ইরান পাকিস্তান সীমান্তের পশ্চিমে। এখান থেকে কিছুটা দূরে গেলেই পাকিস্তানের গদর বন্দর। যেখানে চীনের প্রভাব প্রবল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাবাহার আর গদর, এই দুই বন্দর কিন্তু পরস্পর প্রতিস্পর্ধি। দুটোই গভীর সমুদ্র বন্দর। এখন না হয়, ইরান আর পাকিস্তান একে অপরের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে বন্ধুত্বের সম্পর্কে এসেছে। কিন্তু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক একদমই ভালো ছিল না। এমনকি একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা করতেও দুবার ভাবেনি। আরে এত ঝামেলার মূল সূত্রপাত, দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। যেখানে ইন্ধন জুগিয়েছে এই দুই বন্দর। ইরানের কাছে চাবাহার বন্দর এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেও পারবেন না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিকি দুনিয়া যদি ইরানকে কোনঠাসা করেও দেয়, তাহলেও কিন্তু তেহেরান অতি সহজে এই বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন করতে পারবে। ইরানের পাশাপাশি ভারতের কাছে চাবাহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্দর হয়ে উঠেছে। দেখুন, আফগানিস্তান আর মধ্য এশিয়ার মাটিতে যদি বলা হয় ভারতের বাণিজ্যের অন্যতম বাধা কি? তাহলে প্রথমেই চলে আসবে পাকিস্তানের নাম। পাকিস্তানি ভূখণ্ড ভারত ব্যবহার করতে পারে না। সেক্ষেত্রে আফগানিস্তান আর মধ্য এশিয়ার দেশগুলির কাছে ভারতকে পৌঁছাতে গেলে পাকিস্তানকে টপকে যেতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে ঘুরতে হবে অনেকটা পথ। আর সেই জটিল পথকে সোজা করে দিয়েছে ইরান। সোজা কথায় ইরানের চাবাহার বন্দর। ভারত যখন অবিভক্ত ছিল, তখনও কিন্তু ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ ছিল ইরান। তারপর দেশ ভাগ হলে, ইরান তথা মধ্য এশিয়া আর ভারতের মাঝে সড়কপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান। যদিও সেই সময় ভারতের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েনি। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যের বিস্তার জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। নব্বইয়ের দশক থেকে ইরানের সঙ্গে বাড়তে থাকে দিল্লির যোগাযোগ। দুই দেশের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়, ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর। কারণ ভারত আর ইরান দুই দেশই পাকিস্তানের মদদ পুষ্ট তালিবানি সংগঠন এবং তার কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী ছিল। তারপর তো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে পাকিস্তানে তৈরি করে ফেলে গদর বন্দর। তখন ভারতের কাছে বেস্ট অপশন হয়ে ওঠে ইরানের সাহায্য আর চাবাহার বন্দর। বলা হয়ে থাকে, ইরানের এই বন্দর তৈরিতে ভারতের সাহায্য রয়েছে। ২০১৬ সালে চাবাহার নিয়ে ইরান ভারত আর আফগানিস্তানের মধ্যে চুক্তিও হয়েছিল। বহুবার চাবাহার বন্দর দিয়ে আফগানিস্তানের পণ্য ঢুকেছে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা মাঝখানে একটু ভালো চোখে দেখছিল না ইরান। সমালোচক মহলের অভিযোগ, তাই হয়তো ভারতের বহু প্রকল্পে ইরান হ্যাঁ জানাতে একটু দেরি করছিল। তার উপর আফগানিস্তানে তালিবান সরকার গঠনের পর আবার নতুন করে ধাক্কা খায় ভারত-ইরান সম্পর্ক। তবে দুই দেশের সম্পর্ক এখন উন্নতির পথে। চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের খাতে ভারতের তরফে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ওই বন্দর দিয়ে আফগানিস্তানে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন গম পাঠানোর কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
তাই তো বিশেষজ্ঞেরদের একাংশের মতে, আফগানিস্তানকে বেজিংয়ের কবলে পড়া থেকে আটকাতে চাইছেন নয়া দিল্লি। তাই নজরে রয়েছে ইরানও। সম্প্রতি ভারতীয় কূটনীতিদের একটি দল কাবুলে গিয়ে তালিবান সরকারের বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। অর্থাৎ আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে ইরানের চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে ভারত বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়াতে বেশ উদগ্রীব। চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারত ইরানের মধ্যে আলোচনা বহু বছরের। বছর ছয়েক আগে, এই বন্দর বাণিজ্য বিনিয়োগ এবং প্রতিরক্ষা সহ ইরানের সঙ্গে প্রায় নয়টি চুক্তি হয়েছিল। যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে শক্তি, যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়তার মত প্রচুর বিষয়। এছাড়াও দুই দেশই ভিসা নিতে সরল করতে চুক্তিও করেছিল। তবে হয়তো আর অপেক্ষা নয়, ভারত এবং ইরানের মধ্যে ২ দশকেরও বেশি সময় ধীরগতির আলোচনার পর এবার চাবাহার বন্দর নিয়ে একটা দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি চূড়ান্ত হতে পারে। হয়তো সেটা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাধারণ নির্বাচনের পর এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। তারপর ভারতের কাছে আরো প্রশস্ত হবে ইরানের এই বন্দর।
সোজা কথায়, ভারত এখন আরব দুনিয়ায় চলছে অত্যন্ত ভারসাম্য রেখে। সেই আরব আর ইসরায়েলের যুদ্ধের সময় কিংবা তার আগে থেকেই যদি বলা হয়, তাহলে তেহরানের ঘোরশত্রু তেল অভিভ। ইরান আর ইসরায়েলের শত্রুতা কে না জানে। কিন্তু ভারত মাঝে থেকেও কোন পক্ষকে বেছে নেয়নি। থেকেছে নিরপেক্ষ। তাহলে নিশ্চয়ই ভাবছেন, ইরানের সঙ্গে ভারতের যে এত বন্ধুত্বের কথা বলা হচ্ছে, তাহলে সাম্প্রতিক সময় যে বারংবার হুথি বিদ্রোহের কথা উঠে আসছে, সেখানে ইরান কেন নিশ্চুপ? হুথিরা তো ইরান সমর্থিত, অথচ তাদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না ভারতের জাহাজও। দেখুন, এটা নিয়ে কিন্তু ভারত ইরানকে নালিশ জানিয়েছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তেহরানকে বলেছে, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক নয়, ভারতের শক্তি সম্পদ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রেও এই হামলাগুলো এক একটা বড় আঘাত। এর মাধ্যমে কোন পক্ষেরই লাভ হচ্ছে না। দুই দেশের বিদেশ মন্ত্রীর মধ্যে একটা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও হয়। ইরান আর ভারত একে অপরকে বারংবার সাপোর্ট করেছে। তার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস।
এখন না হয় সমঝোতার মাধ্যমে ইরান আর পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হয়েছে, কিন্তু চলতি বছরের প্রথম দিকেই তো ইসলামাবাদ আর তেহরান একে অপরকে হামলা করতে রীতিমত মুখিয়ে ছিল। পাকিস্তানে ইরানের হামলা প্রসঙ্গে ইরানকেই সমর্থন করেছিল ভারত। যদিও সরাসরি নয়, অনেকটা ঘুর পথে। পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটিতে ইরান এয়ারস্ট্রাইক চালালে, শুরু হয় দুই দেশের কূটনৈতিক লড়াই। তখন ভারত বলেছিল, বিষয়টা সম্পূর্ণ ইরান আর পাকিস্তানের বিষয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় তাহলে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারত রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতিতে। সেখানে ভারতের অবস্থান একেবারেই আপোষহীন। যখন নিজেদের আত্মরক্ষায় কোন দেশ কোন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, সেই বিষয়টা আমরা বুঝি। এই যে আমরা বুঝি, এর মানে কিন্তু অনেকটা ঘুর পথে ইরানকে সাপোর্ট করেছিল ভারত। এমনটাই মনে করেছিলেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আর যদি মুদ্রার উল্টো পিঠের কথা বলি, তাহলেও কিন্তু ভারত আর পাকিস্তান দ্বন্দ্বে কখনোই ইরান পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেনি। বরং সব সময় ব্যালেন্স করে চলেছে। থেকেছে নিরপেক্ষ অবস্থানে। এইতো কয়েকদিন আগেই পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি। তখন পাকিস্তান কাশ্মীর বিরোধ নিয়ে কথা বলতে চাইলেও, ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রসঙ্গটা ঘুরপথে এড়িয়ে গিয়েছেন। তার মানে এটাই স্পষ্ট, পাকিস্তান আর ভারতের বিরোধের মাঝে ইরান কোন কথা বলতে চাইছে না।
বর্তমানে যুদ্ধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে লোহিত সাগর। এই বাণিজ্য রুটে একদিকে রয়েছে হুতি গোষ্ঠী, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে ইসরাইলের পক্ষে। আর এখানে ঢুকে পড়েছে ইরানও। তেহরান তো বরাবরই হুথি গোষ্ঠীকে সমর্থন করে আসছে। তবে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র, হুথি আর ইসরায়েলের সংঘাতের মাঝে অটুট রয়েছে ভারত আর ইরানের বন্ধুত্ব। এইতো, ২০২২- ২৩ অর্থবছরে ভারত আর ইরানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল প্রায় ২.৩৩ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২১.৭৬ শতাংশ। ভারত থেকে মূলত ইরানে রপ্তানি হয় বাসমতি চাল, চা, চিনি, তাজা ফল, ওষুধ, কোমল পানীয়, ডাল সহ বহু পণ্য। ওদিকে আবার ইরান থেকে ভারতে আসে মিথানল, পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, আপেল, তরলীকৃত প্রোপেন, শুকনো খেজুর, অজৈব/জৈব রাসায়নিক, বাদাম প্রভৃতি।তবে হ্যাঁ, এখানে একটা চিন্তার বিষয় রয়েছে। গত পাঁচ বছরের হিসেবে ইরান আর ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। তাইতো দুই দেশ একে অপরের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে বাড়াতে আগ্রহী।
https://youtu.be/8rSkp5H-NTQ?si=UG-1Kou95gW25Jyw
এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, সমালোচক মহলে জোর গুঞ্জন উঠেছে, লেখালেখিও হচ্ছে, পাকিস্তান নাকি ফলো করছে ভারতকে। ভারতের মতো ইরানের প্রতি একটা স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্রমাগত পাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার হুমকি। ভারত কিন্তু পশ্চিমা চাপ থাকা সত্ত্বেও, রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যেও রয়েছে তারা শীর্ষে। পাকিস্তানও হয়তো এবার ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই ইরানের সাথে ইসলামাবাদ বাণিজ্য বাড়াতে বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছে। উপেক্ষা করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম