।। প্রথম কলকাতা ।।
India-Bangladesh: ভারতের দক্ষিণের ছোট্ট একটা দ্বীপ কচ্ছতিভু। যার অবস্থান ভারতের তামিলনাড়ু থেকে কিছু দূরে, রয়েছে তামিলনাড়ু আর শ্রীলঙ্কার মাঝে। সমুদ্রে ঘেরা এই দ্বীপ নিয়েই ভারতের মোদী সরকার তুলল একগুচ্ছ প্রশ্ন। আঙ্গুল তুলল কংগ্রেসের দিকে। কচ্ছতিভু ইস্যুতে একে অপরকে বিঁদছে ভারতের শাসক- বিরোধীরা। আসলে ইন্দিরা গান্ধী এই দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিল। আর সেই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে যখন সরকারপক্ষ কথার জালে আক্রমণ করছে, তখনই উঠছে একটা বড় প্রশ্ন। তাহলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সাথে হওয়া ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট কেন করেছিল মোদী সরকার? প্রায় একশ এগারোটা ছিটমহল বাংলাদেশকে দিয়ে দেওয়ার কারণ টা কী? তাহলে কি বিজেপিও কংগ্রেসের মতো নিজের দেশের জমি অন্য দেশকে দিয়ে দিয়েছিল? বাংলাদেশকে এত বড় জায়গা কেন নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন? যেখানে বিজেপি সব সময় নিজেদের রাষ্ট্রবাদী বলে দাবি করে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে ভারতের জায়গা দেওয়ার আসল সিক্রেট টা কি? পিছনে রয়ে গিয়েছে কোন রহস্য?
মূলত এই কচ্ছতিভু রয়েছে ভারতের তামিলনাড়ুর কাছাকাছি। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষর করেছিলেন ভারত শ্রীলংকা সামুদ্রিক চুক্তিতে। এ চুক্তির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার অংশ হয়ে যায় এই দ্বীপ। আসলে স্বাধীনতার পর এই দ্বীপ নিয়ে সমস্যার অভাব ছিল না, যার মূল কারণ ছিল দ্বীপটির চারপাশ থেকে মাছ ধরা নিয়ে। শেষে ভারত সরকার শ্রীলংকার সঙ্গে ঝামেলা শেষ করতে এবং দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করতে ১৯৭৪ সালে দ্বীপটা শ্রীলংকার কাছে হস্তান্তরের সম্মতি দেয়। সম্প্রতি ভারতের বিদেশ মন্ত্রী, এস জয়শঙ্কর থেকে শুরু করে শাসক দল দেশের প্রাক্তন দুই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর এমন মনোভাব কিংবা সিদ্ধান্ত যাই বলুন না কেন, তার কড়া সমালোচনা করেছে। আর তখনই বিরোধীরা আক্রমণ করছে সরকারি পক্ষকে। তাহলে ভারত কেন বাংলাদেশকে দিয়েছিল ১১১ টা ছিটমহল?
ভালো করে দেখুন, এই যে ভারত আর বাংলাদেশের বর্ডার,এখানে কিছু ছোট ছোট টুকরো এলাকা রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু অংশ ছিল ভারতে। আর ভারতের কিছু অংশ ছিল বাংলাদেশে। যাকে বলা হয় ছিটমহল। সহজ ভাষায়, এই টুকরো টুকরো জায়গা গুলো নিজের দেশের সাথে নয়, বরং ঘিরে ছিল অন্য দেশের দ্বারা। যার কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল এখানকার মানুষদের জীবন। না তারা পারছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতের নাগরিকত্ব ভোগ করতে, না পারছিল বাংলাদেশের নাগরিক হতে। কিন্তু কেন এই হাল? কেনই বা তাদেরকে এভাবে দুই দেশের মাঝখানে দীর্ঘ বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল? বলা হয়ে থাকে, এই কাহানি শুরু হয়েছিল কোচবিহার রাজা আর রংপুরের রাজার মধ্যে হওয়া একটা দাবা খেলার মাধ্যমে। তাদের বিনোদনের মাশুল দিতে হয়েছে ছিটমহলের সাধারণ মানুষকে।
শোনা যায়, তখন নাকি দাবা খেলার মাধ্যমে যে যার অংশ বাজি ধরত। আর বাজি হেরে গেলে সেই পরাজিত রাজার অংশ পেয়ে যেত বিজয়ীপক্ষ। তবে আসল কাহিনীটা শুরু হয় ১৭১৩ সালে। কোচবিহারের রাজা এবং মোঘল শাসকদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় একটি চুক্তি, যেখানে ঠিক করা হয় এই ছোট ছোট টুকরোর জায়গাগুলোর ট্যাক্স কালেক্ট করবে তারা। তবে কার অংশে কোন কোন ছিটমহল গুলো থাকবে, তার স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পেল। পাশাপাশি ইংরেজরা বাউন্ডারি তৈরি করে দিল ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। তখন ছিট মহলের কিছু থেকে যায় ভারতে, আর কিছু টুকরো চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে। সেই সময় কোচবিহারের সামনে অপশন ছিল, ভারতের সাথে যোগ দেবে নাকি পাকিস্তানের সাথে। ১৯৪৯ সালে কোচবিহার ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর ঠিক সেই সময় দুই দেশের মাঝে ফেঁসে যায় এই ছিটমহল গুলো।
১৯৫৮ সাল নাগাদ তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন আলোচনাক্রমে একটা সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বলা হয়, ল্যান্ড ট্রান্সফারের জন্য কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্ট এর অর্থাৎ সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যতদিনে এই সংশোধন হয়, ততদিনে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়েছে। যার কারণে সেই সময় হওয়া ওই চুক্তির রেজাল্ট ছিল একদম জিরো। তারপর তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা পেয়ে জন্ম নিল আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেতেই দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে যায়, এই ছিটমহল গুলো নিয়ে। ১৯৭৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর, ভারত আর বাংলাদেশের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতায় কিছুটা চিড় ধরে। সেই সময়টা আবারো ঝুলে যায় ছিটমহলের মানুষের জীবন।
২০১৫ সালে রীতিমত এই ছিটমহল অধিবাসীদের ৪৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছিট মহল গুলো মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়। দুই দেশের যৌথ জরিপের তথ্য বলছে, মোট ১৬২টি ছিটমহলে ছিল প্রায় ৫৫ হাজারের মতো মানুষ। এই সময় পরিস্থিতি হয়তো বলে বর্ণনা করা যাবে না। একদিকে আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছিল কিছু মানুষ, আর অপরদিকে একদল মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাবেন, আবার কিছু মানুষ ভাবছিলেন ভারত থেকে কীভাবে বাংলাদেশে চলে যাবেন। ১৯৭৪ সালে ভারত বাংলাদেশ স্থলচীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রোটোকল অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের ৬৮ বছর পর দুটি দেশের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় এই সীমান্ত সমস্যা। বাংলাদেশের ভিতরে থাকা ভারতের ছিটমহল গুলো বাংলাদেশের ভূমি হিসেবে, অপরদিকে ভারতের ভিতরে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহল গুলো ভারতের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। হিসাব অনুযায়ী, ভারতের মধ্যে সেই সময় ছিল বাংলাদেশের ৫১ টি এবং বাংলাদেশের মধ্যে ছিল ভারতের প্রায় ১১১ টি ছিটমহল। ভারতের সেই ১১১ টি ছিটমহল অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের সঙ্গে।
তাই যখন বিরোধীরা কচ্ছতিভু দিবের ঘটনা ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে তুলনা করছে এ, তখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছে এই ছিটমহল বিনিময় মোদীর বিনিময়ে মোদি সরকারের ভূমিকা রয়েছে শুধু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। কারণ তার আগেই নেহেরু-নুন চুক্তি, তারপরে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি আর নরসিমা রাও-খালেদা জিয়া চুক্তি গুলোই কিন্তু ছিল এই স্থল সীমা চুক্তির মূল ভিত্তি। আর যার ফসল পাওয়া মেলে ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় এর মাধ্যমে।
প্রথম থেকেই ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সরকার যতই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সোনালী অধ্যায় বলুক না কেন, দুই দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ কিন্তু তাদের প্রতিবেশী সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময় কিছুটা নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করছে। সেটা দিনের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে, যদি সোশ্যাল মিডিয়া খোলেন। দেখতে পাবেন, কিভাবে ভারত এবং বাংলাদেশী কিছু নাগরিক একে অপরের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে। কখনো বা সেটা পৌঁছে যায় গালিগালাজের পর্যায়ে। তবে হ্যাঁ, এখানে কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কিছু মানুষ আছে যারা ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ককে অত্যন্ত মর্যাদা দেন এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভাবটা আজীবন জারি রাখতে চান। কারণ বাংলাদেশের কাছে ভারতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রতিবছর লক্ষ্য লক্ষ্য বাংলাদেশী চিকিৎসা থেকে পর্যটন নানান প্রয়োজনে ভারতে আসেন। আর এই সংখ্যাটা কিন্তুনেহাত কম নয়। বরং দিনের পর দিন আরও বেড়েই চলেছে। তাই এই কিছু মানুষের ভারত বিরোধিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় ভারত সরকার।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম