।।প্রথম কলকাতা।।
Isfahan in Iran: বর্তমানে ইরানকে এত ক্ষমতাশালী বলা হচ্ছে কেন? গত কয়েক দশকে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে। এত জোর পাচ্ছে কোথা থেকে? আসলে ইরান আত্মবিশ্বাসী, নিজের দেশের মাটিতে এমন সব কর্মকাণ্ড করে রেখেছে, যা নজরে পড়ছে শত্রুদের। ইরানের সব সিক্রেট লুকিয়ে ইস্পাহান শহরে, এই অঞ্চলকে দেশটার মূল চালিকা শক্তি বলা যেতে পারে। যেখানে তেহরানের পারমাণবিক সক্ষমতার বিকাশ ঘটছে। কি এমন আছে এখানে? যার কারণে, একে বলা হয় ইরানের লুকানো রত্ন? আবার কেউবা বলেন অর্ধেক পৃথিবী। কারণটা কী? বারবার ইসরায়েলের টার্গেটে ইরানের ইস্পাহান শহর কেন? অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় এই শহরে লুকিয়ে রয়েছে ইরানের কোন খাজানা?
ইরানের এক সমৃদ্ধশালি শহর ইসপাহান। সম্প্রতি গোটা বিশ্বজুড়ে চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছিল এই একটা নাম, যেটা ছিল ইসরায়েলের টার্গেটে। এই শহরটা ইরানের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর বলা যেতে পারে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ইরান যে সক্ষমতা অর্জন করেছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই অঞ্চল। হতে পারে ইরানের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে তেহেরান, কিন্তু ইরানের সামরিক শক্তির ভিত ইসপাহান। কেনই বা শহরটাকে এত গুরুত্ব দেয়া হয়? আর কেনই বা ইরানের শত্রুপক্ষদের নজর রয়েছে এই শহরের দিকে? শুধু সামরিক কারণেই নয়, শহরটার ইতিহাসও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এটি বিশ্বের বড় শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম। ইস্পাহান ইরানের তৃতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল শহর। এখানে বসবাস করেন প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ। দেশটার অপর দুই জনবহুল শহরের তালিকায় রয়েছে তেহেরান এবং মাহশাদ। ইসপাহানকে আধুনিক ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটন এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন স্কোয়ার বলা হয়ে থাকে নকশ ই জাহানকে, যেটি রয়েছে এই স্থানে। ঐতিহ্যপ্রাপ্ত স্কয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল ১৫৯৮ থেকে ১৬২৯ সালের মধ্যে। ইরানের অন্যতম পারমাণবিক কেন্দ্র নাতাঞ্জও রয়েছে এই শহরে। এছাড়াও এখানে একটি ইরানি সামরিক বিমান ঘাঁটি রয়েছে। যেখানে এফ-১৪ টমক্যাট যুদ্ধবিমানের একাধিক স্কোয়াড্রন লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি রয়েছে একাধিক সামরিক গবেষণা, উন্নয়ন সুবিধা এবং ঘাঁটি সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
দেখুন, বহুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠেছিল যে নেতানিয়াহুর ইরানকে টার্গেট ইরানে হামলা চালাতে পারে। তবে ইরানের কোন বস্তুতে আক্রমণ করতে পারে সেটাই ছিল সবথেকে বহুল চর্চিত প্রশ্ন। তখনও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসে, ইরানের পরমাণু স্থাপনা, পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ঘাঁটি, সহ অবকাঠামো গুলো। আর সত্যি সত্যিই, খুঁজে খুঁজে সেই রকম একটি জায়গায় হামলা চালিয়েছিল তেলআবিব। যেখানে রয়েছে ইরানের পর পরমাণু স্থাপনা, আর এটা ইসপাহান শহর। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও কিন্তু এই শহরে থাকা ইরানের সেনাবাহিনীর মালিকাধীন একটি সামরিক কারখানায় কয়েকটি ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়েছিল। কৌশলগত দিক থেকে কিন্তু এটা ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাজধানী তেহরান থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহরটি। ইরানের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা আর সামরিক বিমান ঘাঁটির আবাসস্থল।
যদি ইতিহাসের কথা বলা হয়, তাহলে সাফাভি রাজবংশের শাসনামলে ইসফাহান ছিল পারস্যের রাজধানী। এই স্থানকে রাজধানীতে পরিণত করেছিলেন শাহ আব্বাস। পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতাব্দীতে শহরটির সংস্কার করা হয়, যা হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বড় শহর গুলোর মধ্যে একটি। ইসফাহানের গ্র্যান্ড বাজার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পুরনো এবং বড় বাজার গুলোর মধ্যে একটি । ইসলামী স্থাপত্য, ছাদ ঢাকা সেতু, মসজিদ ও মিনারের অসাধারণ সৌন্দর্য ইস্পাহানকে পরিণত করেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। অনেকে বলে থাকেন, ইস্পাহানের সৌন্দর্য নাকি কিংবদন্তি তুল্য। একটা সময় এই শহরকে বলা হতো ইস্পাহান নাসফ ই জাহান অর্থাৎ যার আক্ষরিক অর্থ ইসপাহান অর্ধেক বিশ্ব। শুধু তাই নয়, এই শহর দু দুবার ইরানের রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। সেই আখেমেনিয় সাম্রাজ্যের সময় থেকে কাজার রাজবংশের শেষ পর্যন্ত, এই সময়টা কিন্তু কম নয়, এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিস্তৃত ইস্পাহানের ইতিহাস। প্রচুর উত্থান পতন দেখেছে এই এলাকা। প্রায় ১৪টা ভিন্ন সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছে এই অঞ্চল। ইস্পাহানের সমৃদ্ধি কাল ছিল ১০৫০ থেকে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। খ্যাতি আর সৌর্যের শীর্ষে পৌঁছে যায় সাফাভি সাম্রাজ্যের সময়। তবে মঙ্গলদের হামলায় ইরানের অন্য শহরের মতোই কিন্তু একসময় এই শহরটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মিলিয়ে যায়নি। শাহ আব্বাস তাঁর শাসন আমলে ইস্পাহানকে নিজের রাজধানী শহর হিসেবে নির্বাচন করে। তারপরে ধীরে ধীরে শহরটি আবার ফিরে পায় হারানো ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য। তৎকালীন সময়, ইউরোপ থেকে শুরু করে দূরপ্রাচ্য, যে সমস্ত বণিকরা বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতেন, তাদের কাছে একটা আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল ইস্পাহান। সাফাভি শাসনামলে এখানে একের পর এক গড়ে ওঠে পাঠাগার, মসজিদ, বহু স্থাপনা যা রীতিমতো অবাক করে দেয় ইউরোপীয়দের। ঠিক এই সময়কালেই নাকি ইস্পাহানে গড়ে উঠেছিল প্রায় ১৬৩ মসজিদ, ৪৮ টি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ১৮০১ দোকান। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় দাঁড়িয়ে এটা কিন্তু কম বড় কথা ছিল না। ইসপাহান মূলত বিখ্যাত জায়নামাজ, শতরইঞ্চি, গালিচা বস্ত্র, ইস্পাত এবং অস্ত্র শিল্পের জন্য। আর যদি এখনকার কথা বলা হয়, তাহলে তো ইরানের শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই শহর। এখানে রয়েছে ইরানের প্রচুর বেশ কয়েকটা পারমানবিক জ্বালানি উৎপাদনের চুল্লি, যেখানে মজুদ করা প্রচুর ইউরেনিয়াম।
শহরটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে মসজিদ জামে ইসপাহান। প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস গায়ে মেখে এই মসজিদটি এখন সৌন্দর্য পিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ব্রিটিশ পর্যটক রবার্ট বায়রন ইসপাহানকে তুলনা করেছেন রোমের মতো ঐতিহ্যবাহী স্থানের সঙ্গে। ইস্পাহান শহর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে কাশান শহর। যার অবস্থান অদ্ভুতভাবে রয়েছে ইরানের কেন্দ্রীয় মরুভূমি আর কারাকাস পর্বতের মাঝে। বলা হয়ে থাকে, মানব ইতিহাসের নাকি একটি প্রাচীনতম বসতি গড়ে উঠেছিল এখানকার সিয়ালক টিলায়। এছাড়াও নতুন নতুন যে সমস্ত নিদর্শন এখানে পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো দেখে গবেষণা করে বিশেষজ্ঞদের মতে,শহরটি প্রায় ৭ থেকে ১১ হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাসের সাক্ষী বলছে, এই জায়গার অচলাবস্থার যুগ ছিল ত্রয়দশ শতাব্দী। তবে সাফাভি আমলে জায়গাটি পৌঁছে যায় খ্যাতির শীর্ষে। সেই সময় যে সমস্ত পর্যটক ইরান সফরে এসেছিলেন, তারা প্রত্যেকেই এই জায়গার সৌন্দর্য এবং উন্নয়নে মুগ্ধ হয়ে প্রচুর প্রশংসা করেছেন।
এই যে ইরানের ইস্পাহান নিয়ে এত ইতিবাচক কথা, সবকিছুরু কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, শহরটির অনুকূল অর্থনৈতিক, সামাজিক আর একটা সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। যার কারণে এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০০০ টিরও বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ইরানের বড় বড় খনিজ তেল শোধনাগার গুলো রয়েছে এই শহরে। এছাড়াও রয়েছে ইরানের সবচেয়ে উন্নত উড়োজাহাজ তৈরীর কারখানা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকায় জায়গাটি বিশেষ গুরুত্ব পায় গোটা বিশ্বের কাছে। ইতিহাস আর চিত্তাকর্ষক স্থাপত্যের কারণে অনেকেই শহরটিকে ভালোবেসে বলেন ‘ইরানের লুকানো রত্ন’। এই শহর ইরানের অন্যতম হাতিয়ার। এই শহর ছাড়া ইরান দুর্বল।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম