।। প্রথম কলকাতা ।।
Fire Fighter: আগুনের(fire) সাথে তাদের যুদ্ধ(fight)। এক মুহূর্ত দেরি করলেই সব শেষ। যেখানে নিজেদের জীবনের কোন মায়া নেই। দৌড়াতে হয় ম্যারাথনের মতো। এক সেকেন্ডে দাঁড়িয়ে পড়লে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে আগুনের লেইহান শিখা। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সব। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের আর্তনাদ শোনা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। বলা হচ্ছে দমকল বিভাগের কথা। যাদেরকে বলা হয় যারা বিপর্যয় মোকাবিলা টিমের প্রাণ ভোমরা। এরা নিজেদের পরোয়া করে না। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যকে বাঁচাতে। এত সাহস এরা পান কোথা থেকে? কিভাবে হয় এই কঠিন কাজের ট্রেনিং? এনাদের কাছে ৫ তলা বিল্ডিং এর উপর শুধুমাত্র মই বা ল্যাডারের সাহায্যে দৌড়ে উপরে উঠে যাওয়া তুচ্ছ ব্যাপার। কেজি কেজি ভারি পাইপ কাঁধে তুলে দৌড় দেওয়া যেন জল ভাত। দাউদাউ জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে উদ্ধার করতে এনারাই পারে। দমকল বাহিনীর কাজ যেন সিনেমা দৃশ্য। এক এক জন আসল হিরো। ময়দানে শত্রুর সাথে যুদ্ধে বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র কিংবা গোলাবারদ যথেষ্ট কিন্তু আগুনের সাথে যুদ্ধ করা যে সে ব্যাপার নয় । এই দমকলের ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রায় ১৫০ বছর আগে। ঢাকা থেকে কলকাতা, এখনো রয়ে গিয়েছে লাল দমের কল।
প্রতিবছর আগুন যোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে গোটা বিশ্বজুড়ে ৪ই মে পালন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফায়ার ফাইটারস ডে(International Fire Fighters Day) অর্থাৎ আন্তর্জাতিক দমকল কর্মী দিবস। ঘিঞ্জি শহরের অলিতে গলিতে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিসংযোগ, কখনো বহুতলে আগুন, কখনো বড় বড় শিল্পাঞ্চলে অতর্কিত দুর্ঘটনা, সবকিছুতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন এনারা। তার জন্য কিন্তু এরা কোটি কোটি টাকার মাইনে পান না। গায়ে এমন বিশেষ কোনো পোশাক থাকে না যা ভয়ঙ্কর আগুনকে আটকাতে পারে। আসলে এদের মনে থাকে দুর্ধর্ষ সাহস যা সবকিছুকে হারিয়ে দেয়। যেখানে রাস্তা ভালো নয়, গাড়ি ঢোকে না, সেই রাস্তায় তারা দৌড়ে দৌড়ে জল বহন করেন। এনাদের শুধুমাত্র আগুন নেভান না মানুষের প্রাণ বাঁচান। এর ট্রেনিংও হয় অত্যন্ত কঠিন। ট্রেনিং এর প্রত্যেক ধাপে পাস করতে হয়। তার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কিছু প্রসিডিওর রয়েছে। তারপর রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং মাঠ। যে কোনো ব্যক্তি চাইলেই ফায়ারম্যান হতে পারবেন তবে কিছু গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে যেমন শরীর এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী, সময়নিষ্ঠ আর টিম ওয়ার্কে বিশ্বাসী। ফায়ার ফাইটারদের একা একা কাজ করলে হয় না। দলের সঙ্গে কাজ করতে হয়। বলা হয় ভারতের এনএএফএস বা ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ফায়ার অ্যান্ড সেফটি থেকে যারা ফায়ার ফাইটার কোর্স করে তারা তাদের জীবন নাকি বদলে যায়। ফায়ার ফাইটার দের বিভিন্ন পদ রয়েছে যেমন নিরাপত্তা প্রকৌশলী, ফায়ার ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিগত সেবা ব্যবস্থাপক, নিরাপত্তা পরিদর্শক, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক, ডেপুটি চিফ ফায়ার অফিসার, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, অগ্নি নিরাপত্তা, সুপারভাইজার, ফায়ার সাব অফিসার, স্টেশন অফিসার, অডিটর ফায়ারম্যান, ফায়ার অপারেটর, ফায়ার ইঞ্জিন চালক, দায়িত্বে নিরাপত্তা সহ অনেকগুলি। মূলত এই পদের উপর নির্ভর করে ট্রেনিং এর পার্থক্য হয়ে থাকে। নিয়োগ দেওয়া হয় পৌরসভার বিভিন্ন দমকল অফিস, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভারতীয় নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিমানবন্দর, শিপিং কর্পোরেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিমেন্ট প্লান্ট, স্টিল প্লান্ট, পেট্রোকেমিক্যাল টেক্সটাইল মিল, প্রতিরক্ষা পরিষেবা, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, ভারতের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, টেক্সটাইল কটন ইন্ডাস্ট্রিজ প্রভৃতি জায়গায়।
ট্রেনিং
দমকল বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। শুধু ভারত নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়ম কম বেশি এক। এছাড়াও লিখিত পরীক্ষা রয়েছে। মূলত মাঠে যে ট্রেনিং দেওয়া হয় তা অত্যন্ত ইম্পর্টেন্ট। এই ট্রেনিংয়ে ফেল করলে তিনি দমকল বাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন না। বিভিন্ন পদ অনুযায়ী ট্রেনিং আলাদা। যিনি গাড়ি চালাবেন তার ট্রেনিং আলাদা, আবার যিনি সরাসরি আগুলের মোকাবিলা করবেন তার ট্রেনিং আলাদা। তবে কমবেশি সবাইকে সাধারণ একটা ট্রেনিং নিয়ে রাখতে হয়। যেমন দ্রুত দৌড়, কাঁধে অত্যন্ত ভারী পাইপ নিয়ে দৌড়াতে হয়, সেই পাইপ থাকে গোটানো। এই পাইপ গোটানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কে কত দ্রুততার সঙ্গে পাইপ সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখতে পারবেন। শরীর রাখতে হয় একদম ফিট। তার জন্য প্রতিদিনই শরীর চর্চার প্রয়োজন। আরেকটি দুর্ধর্ষ ট্রেনিং হল মইয়ের উপর কে কত দ্রুত উঠতে এবং নামতে পারেন। মাটিতে দৌড় দেখেছেন কিন্তু দমকল বাহিনীকে দেখবেন রীতিমত দৌড়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন। যেখানে ব্যালেন্স ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। জলের পাইপের সংযোগ অলিতে গলিতে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়া তার জন্য রোডম্যাপের এক সম্মুখ ধারণা থাকা দরকার। কিভাবে দ্রুত আগুন নিভাতে হয়, আগুনের মোকাবিলা করতে হয় প্রভৃতি বিষয় ট্রেনিং দেওয়া হয়। পাইপ গোটানো, আগুন নেভানো প্রত্যেকটাই যেন এক একটা আর্ট, সামান্য ভুলচক হলে সর্বনাশ। প্রত্যেক কাজে থাকতে হয় নিখুঁত সময় জ্ঞান। এছাড়াও ট্রেনিংয়ে দেখা হয় কে কতটা বিচক্ষণ। সঠিক সময়ে কিভাবে আগুন নিভিয়ে দ্রুত বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সেই বুদ্ধির পরীক্ষাও করে নেওয়া হয়।
ট্রেনিং পিরিয়ড
ট্রেনিং সাধারণত তিন মাসের হয়। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে বেহালাতে। যাকে বলা হয় আইএফএস বা ইনস্টিটিউট অফ ফায়ার সার্ভিস। এছাড়াও এখন বড় বড় ফায়ার স্টেশনে ট্রেনিং হয়ে দেওয়া থাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিং এর প্রথম দিন সবাইকে ড্রেস এবং নিয়ম সম্পর্কে অবগত করা হয়। ড্রেস সাদা হাফ প্যান্ট, সাদা গেঞ্জি, সাদা কেটস আর চুল একদম ছোট ছোট করে কাটা, আর দাড়ি গোঁফ সেভ করা। ট্রেনিংয়ে মূলত সকালে প্যারেড থাকে। সকাল সাতটা থেকে ট্রেনিং শুরু হয়। তিন থেকে চার ঘন্টা প্যারেড হয় তারপর কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে ক্লাস শুরু হয়। এছাড়াও গাছপালা কাটা, গ্রাউন্ড পরিষ্কার করা এগুলি ট্রেনিং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই ভাবে সারাটা দিন কাটে। ট্রেনিং শেষ হয় সেই বিকাল চারটে থেকে পাঁচটা নাগাদ। ট্রেনিংয়ে থাকে বেশ কয়েকটি জিনিস । রোপ ক্লাইম্বিং, লং জাম্প, হাই জাম্প আর রান। এছাড়াও প্যারেড হয়, স্যালুট করা, কিভাবে আগুনের জল দিতে হয় সেটা শেখানো হয়। কোন আগুনের জল না দিয়ে ফোম দিতে হয় সেটাও শেখানো হয়। কি করে উঁচু বিল্ডিং থেকে ল্যাডারের মাধ্যমে মানুষকে রেসকিউ করতে হয়, আগুনের ধরন ও আগুন নেভানোর পদ্ধতি শেখানো হয়।
দমকল কেন বলা হয়?
দমকল অর্থাৎ দম দেওয়া কল। কোনদিন ভেবে দেখেছেন এই ফায়ার ব্রিগেড বা সার্ভিসের নাম কেন বাংলায় দমকল বলা হয়? এই শব্দটার সঙ্গে ফায়ার ব্রিগেড বা সার্ভিসের কি আদৌ কোন যোগ রয়েছে? একসময় কোথাও আগুন লাগলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচের ঘর ভেঙে তার মধ্যে থেকে টেলিফোনের হ্যান্ডেল ঘোরাতে হতো। এটা কোন অপরাধ নয়, এমনটাই নির্দেশিকা। তা স্পষ্টভাবে লেখাও থাকতো। “আগুন লাগিলে কাঁচ ভাঙিয়া টেলিফোনের হ্যান্ডেল ঘুরাও”। মূলত এই টেলিফোন ফায়ার বিগ্রেডকে সতর্ক করার এক বিশেষ যন্ত্র। প্রায় দেড়শ বছর আগে বিভিন্ন রাস্তায় লাল রঙের লোহার বাক্স বসানো থাকতো। এখনো আপনি পুরনো বিল্ডিংগুলোতে গেলে এই বাক্স দেখতে পাবেন। কাছে থাকা এক খোপের মধ্যে থাকতো হাতল ঘুরিয়ে দম দেওয়ার একটা যন্ত্র। সেই হাতের ঘোরালে দ্রুত খবর চলে যাবে দমকল দপ্তরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসে দেখেছিল কলকাতা শহরে তখন ম্যাক্সিমাম খড়ের চালের বাড়ি। যার কারণে আগুন লাগা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অথচ ঘটনা স্থলে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। তাই এই দম দেওয়ার যন্ত্র বিভিন্ন জায়গায় রেখে দেওয়া হয়। যেখানে হাতল ঘোরালে মাটির নিচে পাতা তারের মাধ্যমে দ্রুত খবর চলে যাবে ফায়ার ব্রিগেডের কাছে। যেহেতু দম দেওয়া কল দিয়ে এই বিশেষ বাহিনীকে ডাকা হত তাই তাদের বলা হয় দমকল। সেই সময় কলকাতা, ঢাকা সহ ভারতের বড় বড় শহরে ব্রিটিশরা এই যন্ত্র বসিয়েছিল।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম