।। প্রথম কলকাতা ।।
Sudan crisis: বলা হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক অনাহার সংকট দেখবে সুদান। হলোও তাই, সেখানকার মানুষ খাবারের জন্য ছটফট করছে। এক টুকরো খাবার কোথায় পাওয়া যায় সেই চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা। পেটে তীব্র জ্বালা, কিন্তু কোথাও কোনো খাবার নেই তাই ঘাস খেয়ে চিনে বাদামের খোসা খেয়ে কোনো রকমে তাদের দিন কাটছে।।চারিদিকে খাবারের হাহাকার। লাখ লাখ মানুষ অনাহারের সম্মুখীন। মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু খেতে না পেয়ে। এক বেলাও খাবার জুটছে না। এরকম দুর্ভিক্ষ দেখে হতবাক হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব। ভয়, আতঙ্ক ঘিরে ধরছে। একটু খাবারের কতই না দরকার।
বর্তমানে ৯০ শতাংশ মানুষ “অতি মাত্রায় অনাহারে” ভুগছে তাদের কাছে পোঁছাতে পারছে না খাবার। সুদানের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ দিনে এক বেলা খাবার জোগাড় করতে সক্ষম এই সময়ে দাঁড়িয়ে। গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সুদানের সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের মানে আরএসএফ মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। পরবর্তীতে এই সংঘাত দেশটিতে গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে অনেক মানুষ। যুদ্ধের কারণে দেশটির কৃষি উৎপাদন ৭৮ শতাংশ কমে গেছে।
আর এ কারণেই আজ দেশটি অনাহারে ধ্বংস হতে বসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম অনাহারের সামনে দাঁড়িয়ে সেখানকার মানুষ। সমস্ত সুদান জুড়ে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার মুখোমুখি হচ্ছে। এদের মধ্যে ৫০ লাখ বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশটির প্রায় ৮০ লাখেরও বেশিমানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এছাড়া সংঘাতের আগে জোরপূর্বক ২০ লক্ষ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর দক্ষিণ সুদানে ছয় বছরের মধ্যে এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষের ঘোষণা।
গৃহযুদ্ধময় পরিবেশ ও চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশটিতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দক্ষিণ সুদানের প্রেসিডেন্ট সালভা কিইর ও প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচারের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মূলত দেশটিকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সুদান মৃত্যুপুরী হয়ে উঠল কেনো? এই দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রায় সত্তর লাখ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হলো কেন? কেন প্রায় ২০ লাখ মানুষকে শরণার্থী হয়ে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হলো? সুদানে আজকের যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, যার ফলে এই ধ্বংসলীলা, তার দায়ভার দুর্ধর্ষ মিলিশিয়া বাহিনীর আর এই বাহিনী তৈরির ব্যাপারটার মধ্যে।
এক সময় সুদান ছিল আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ। পরে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ায় এবং আবেই বলে একটা অঞ্চল অমিমাংসিত থেকে যাওয়ায় সুদানের ভৌগোলিক আকার কিছুটা ছোট হয়ে যায়। সুদানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে দারফুর এলাকা।। এই এলাকায় তিনটি প্রদেশ—উত্তর দারফুর, দক্ষিণ দারফুর ও পশ্চিম দারফুর। উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাসির হচ্ছে এই এলাকার সবচেয়ে বড় শহর। সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে এই শহরের দূরত্ব বারো শ’ কিলোমিটারের মতো। দক্ষিণ সুদান বাদে দারফুরসহ সুদানের অধিবাসীদের শতাভগই ইসলাম ধর্মের।
এই লড়াই আসলে গোষ্ঠীর মধ্যে।। দারফুর মানে ফুর জনগোষ্ঠীর এলাকা। এই ফুররা জাতিগতভাবে আফ্রিকান গোত্রের। সুদানের বাকি অংশের মানুষ আরব গোত্রের। ফুরদেরকে শাসক আরব গোষ্ঠীগুলো অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণির জনগোষ্ঠী বলে মনে করে। এবং দীর্ঘকাল ধরে সুদানে ফুররা বিভিন্ন রকম বৈষম্যের শিকার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত দারফুরের সব প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় শহরে একটিমাত্র পাকা রাস্তা ছিল। একটিমাত্র চারতলা ভবন ছিল। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তেলসমৃদ্ধ একটা দেশের একটা অঞ্চল কতটা পিছেয়ে পড়া।
এসব অসন্তোষ নিয়েই মূলত দারফুরের গোষ্ঠীগত সংঘাত বা গৃহযুদ্ধের সূচনা। ২০০৩-এর দিকে এই সংঘাত মারাত্মক রূপ নেয়। এতে জড়িয়ে পড়ে দারফুরের কৃষিজীবী আফ্রিকান গোত্রগুলো ও পশুপালক যাযাবর আরব গোত্রগুলো। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের সরকার শক্ত অবস্থান নেন ফুরদের বিরুদ্ধে। ফলে এই শতাব্দীর অন্যতম বড় মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে এই সংকটে দারফুরে দুই লাখের বেশি মানুষ মারা যায়; বাস্তুচ্যূত হয় আরও অন্তত তিন লাখ মানুষ। ২০০৩ সালে দারফুরে গৃহযুদ্ধ যখন প্রচণ্ডভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ফুরদেরকে দমনের জন্য সুদান সরকার সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি আরব গোত্রের জনজাওইদ মিলিশিয়াদের কাজে লাগায়।
এদের নৃসংশতা সুদানের সামরিক বাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। সাধারণত সুদানের প্রতিরক্ষা বাহিনী ফুর লোকালয়ে প্রথমে বোমা হামলা করত। এবং তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জনজাওইদ মিলিশিয়ারা ঘোড়ায় এবং উটে চড়ে সেখানে পৌঁছাত। তারা তখন হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো করত। দারফুরের গৃহযুদ্ধের যখন তীব্রতা কমতে থাকল, তখন প্রশ্ন এল, এই মিলিশিয়াদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এরা সংগঠিত, এদের কাছে অস্ত্র রয়েছে এবং এরা হিংস্র। এদের সামাল দিতে না পারলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিভাজিত এই দেশ শান্ত থাকবে না। প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদেরকে নিয়মিত বাহিনীতে নিয়ে নেওয়া হবে। তাদেরকে সরাসরি সেনাবাহিনীর অংশ না করে তাদের নিয়ে একটা প্যারামিলিটারি বাহিনী গড়ে তোলা হলো ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ নামে।
গত এক বছরে যুদ্ধে কম করে হলেও পনেরো হাজার মানুষ মারা গেছে এবং কমবেশি পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। দেশটির আধা সামরিক বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরুর দশ মাসের মাথায় আবার তীব্র মানবিক সংকটের কবলে দেশটি।। জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছেন। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ। এছাড়া সারা দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট অর্থ আদান-প্রদানে বাধাপ্রাপ্ত করে সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে দেশের বড় একটি অংশ প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের উপর নির্ভর করে। ৫ ফেব্রুয়ারী ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানায় যে উত্তর দারফুরের জমজম শরণার্থি শিবিরে অনাহারে ও খাবারের অভাবে প্রতি ঘন্টায় দুটি করে শিশু মারা যায়।
বর্তমানে যে পরিমাণ খাদ্য সংকট রয়েছে দেশটিতে সেটি যদি স্থায়ী হয় তাহলে আগামী বছরের মধ্যে কয়েক লাখ শিশু সেখানে মারা যাবে। দিন দিন খাদ্য সংকট বৃদ্ধির কারণে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে বিভিন্ন সংস্থাগুলো সুদান এবং দেশটির শরণার্থীদের সাহায্যকারী দেশগুলিতে ৪০০ কোটি ডলার তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জাতিসংঘের অনেক সংস্থা এবং ত্রাণ গোষ্ঠী এই অঞ্চলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে যার কারণে দারফুরের বেসামরিক নাগরিকরা তীব্র ক্ষুধার কবলে পড়েছে। জলবাহিত রোগের কারণেও সারা দেশে অপুষ্টির চরম মাত্রার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ডায়রিয়ায় ও জলবাহিত রোগে ভুগছে।
২০০৩ সালে দারফুরের প্রথম বড় গৃহযুদ্ধের সময় জমজম শরণার্থি শিবিরটি স্থাপিত হয়। বর্তমান যুদ্ধের আগে থেকেই শিবিরটিতে প্রায় ৪ লাখ মানুষের বাসস্থান। সুদানে এই যুদ্ধের কারণে খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং মানুষের কেনার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে দেশটির আধা সামরিক বাহিনী সারাদেশ থেকে পরিকল্পিতভাবে সাহায্য গুদাম, ব্যাংক, গাড়ি, বাড়ি এবং গয়না লুট করেছে। এতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
দুদিন আগে এক বছর পূর্ণ হলো সুদানের এই নতুন সংঘাতের। এখনো পর্যন্ত আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দারফুরের গৃহযুদ্ধের সময়ে প্রথমে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও পরে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের যৌথবাহিনী দারফুরে শান্তিরক্ষার কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক পক্ষসমূহের চেষ্টায় ‘জেদ্দা চুক্তি’ হলেও এই যুদ্ধ থামেনি। এবারও আন্তর্জাতিক মহল এমন কোনো উদ্যোগ নেয় কিনা, সেটা দেখার বিষয়।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম