।। প্রথম কলকাতা ।।
Extinction of Biodiversity: জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের দেশ। কিন্তু চোরাশিকারিদের পাতা ফাঁদ আর মানুষের সীমাহীন লোভে আমরা হারিয়ে ফেলছি অসম্ভব সুন্দর সব প্রাণীদের। যার কারণে তাদের সংরক্ষণের কথা ভাবতে হচ্ছে। কোন প্রাণীর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তখনই পড়ে যখন সেটি অপ্রতুল অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সারা পৃথিবী জুড়ে নানান জীবের সমাহার আছে বলেই পরিবেশের শক্তি প্রবাহ ঘটে। খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে ভিত্তিতে বেঁচে থাকে প্রত্যেকটি প্রাণী। জীবিত বৈচিত্র্য আছে বলেই মানুষ খাদ্যের যোগান পায়, শিল্পের জন্য কাঁচামাল পায়, বিনোদন এবং পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারে। অথচ যারা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে আজ তারাই মহাবিপদে। ভারতের রেড ডাটা বুকের তথ্য জানলে কিছুটা আঁতকে উঠবেন। যাদের সঙ্গে ছোটবেলায় আপনার পরিচয় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল আজ তারাই রেড ডাটা বুকে নাম তুলেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (IUCN) বিভিন্ন লুপ্তপ্রায় জীব প্রজাতির একটি বিশদ তালিকা প্রকাশ করে, যাকে বলা হয় রেড ডাটা বুক। আর যারা অবলুপ্তির বিপদ থেকে মুক্ত তাদেরকে যোগ করা হয় গ্রিন ডাটা বুকে। আর ব্ল্যাক ডাটা বুকে থাকে ক্ষতিকর কিংবা হানিকর জীব প্রজাতির নাম।
পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রজাতির গড় আয়ু হয় ১০ লক্ষ বছর। প্রতি বছর এক থেকে তিনটি করে প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আর প্রতি ২০০ বছরে বিলুপ্তি ঘটছে একটি করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর। কয়েক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত সব আশ্চর্যজনক প্রাণী। পৃথিবীর সর্বকালের বৃহত্তম স্থলচর প্রাণী হল ডাইনোসর। প্রায় ১৯ কোটি বছর আগে তা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এছাড়াও দশ হাজার বছর আগে অবলুপ্ত হয়েছে বড় বড় লোম ওয়ালা বিরাট দাঁতাল হাতি , যাকে বলা হয় ম্যামথ। ঠিক সরীসৃপ নয় আবার ঠিক পাখিও নয়, এই দুয়ের মাঝামাঝি একটি প্রাণী ছিল, যাকে বলা হত আরকিয়পটেরিক্স। প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে তারও বিলুপ্তি ঘটেছে। তবে এই বিলুপ্তি হয়েছে কালের নিয়মে। কিন্তু বর্তমানে যেটা হচ্ছে সেটা অন্যায় ভাবে। কোথাও গিয়ে জোর করে বন্য জীবজন্তুদের থেকে তাদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। চোরাশিকারি আর সাধারণ মানুষের লোভের কারণে বিপন্ন ভারতের বহু প্রজাতির প্রাণী। সেই তালিকায় রয়েছে –
সরীসৃপ – কুমির, মেছো কুমির
পাখি – সাদা ঠোঁট ওয়ালা সিন্ধু ঈগল, বড়ো বাজ, ঘুঘু, সাদা কানওয়ালা ফেজেন্ট, রাজ ধনেশ প্রভৃতি।
স্তন্যপায়ী – কৃষ্ণসার হরিণ, ভারতীয় ও আফ্রিকার বন্য গাধা, কস্তুরী মৃগ, তুষার চিতা, বেঙ্গল টাইগার, এক শৃঙ্গী গন্ডার, নীলগিরি তহর, এশিয়াটিক সিংহ।
ICUN অনুযায়ী বিপন্ন প্রজাতির ভাগ
১. লুপ্ত – যাদের বিগত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। যেমন – চিতা
২. বন্য পরিবেশে লুপ্ত- যারা বন্য পরিবেশে লুপ্ত কিন্তু সংরক্ষিত পরিবেশে অল্প সংখ্যক বেঁচে রয়েছে। যেমন – দ্বীপের মাছরাঙা
৩. চরম বিপন্ন – অবলুপ্ত হওয়ার সম্মুখীন। যেমন – নীল তিমি
৪. বিপন্ন – যাদের বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে। যেমন – কস্তুরী মৃগ, ভারতীয় একশৃঙ্গী গন্ডার, এশিয়াটিক সিংহ
৫. বিপদাপন্ন – যাদের জীবনে বিপদের কারণ রয়েছে, এরা ভবিষ্যতে আরো চরম বিপদে পড়তে পারে। যেমন – শকুন, চড়াই
৬. বিপদের স্বল্প লক্ষণযুক্ত – সামাজিক কারণে যে প্রজাতি বিপদে মুখে। যেমন – গোসাপ, গন্ডার
৭. অনুদ্বিগ্ন প্রজাতি – যাদের যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। যেমন- কাক।
ভারতে এইসব প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য মোট পাঁচ ধরনের প্রটেক্টেড এরিয়া রয়েছে। যার চার ধরনের রয়েছে স্থলভাগে এবং একটি রয়েছে জল ভাগে। সেগুলি হল ন্যাশনাল পার্ক, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, কনজারভেশন রিজার্ভ এবং কমিউনিটি রিজার্ভ।
তবে প্রশ্ন হল, এত পরিমাণে সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তোলা গড়ে তোলার আদৌ কি প্রয়োজনীয়তা আছে ? দিনের পর দিন ভারতেই কমছে বাঘ এবং গন্ডারের সংখ্যা। চোরা শিকারিরা বাঘের চামড়া আর গন্ডারের সিং সংগ্রহ করার জন্য নির্বিচারে বাঘ এবং গন্ডার মারে। কারণ এদের চামড়া আর শিং এর দাম কয়েক লক্ষ টাকা। উপরন্তু এই দুই প্রাণীর জন্ম হার কাম, দিনের পর দিন বনে খাদ্য এবং পানীয় জলের অভাব বাড়ছে এবং বনকে কেটে তৈরি হচ্ছে বসতি। স্বাভাবিকভাবেই এরা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীতে, নাম তুলছে রেড ডাটা বুকে।
প্রত্যেকটি প্রাণী পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তারা বিলুপ্ত হওয়া মানে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি, যার প্রভাব পড়বে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তবে এমন কিছু প্রাণী আছে যাকে হারানোর জন্য আপনার কষ্ট হবে। এদের মুখের দিকে একবার তাকালে সব রাগ ভুলে যেতে পারেন।
১. লজ্জাবতী বানর
অসম্ভব সুন্দর দেখতে। চোখ ভরা মায়া। ‘বাঁদরের বাদরামি’ এই কথা এদের সঙ্গে এক্কেবারে যায় না। অন্যান্য বানরের দৈহিক গঠন এবং চেহারার সঙ্গে এদের পার্থক্য রয়েছে। একবার দেখলে এদের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে ইচ্ছা হবে। এরা গাছের উঁচু শাখায় থাকতে পছন্দ করে। তবে এরা বড্ড লা। তাই বলা হয় লজ্জাবতী বানর। তবে চোরাকারবারিদের জন্য এরা আজ বিপন্ন। এরা অত্যন্ত ধীরগতির এবং এবং প্রচণ্ড অলস। দিনের বেলায় খুব একটা দেখা মেলে না। রাতের অন্ধকারে ধীরগতিতে নিজেদের মতো ঘুরে বেড়ায়। যখনই কারো দেখা পায় তখন দু পায়ের মাঝে মাথা গুঁজে দুই হাতে মুখ ঢাকে, যেন ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। তাই তো এদের বলা হয় মুখচোরা বানর।
২.সোনালী বানর / হনুমান
জাস্ট দু দণ্ড দাঁড়িয়ে এদের দেখবেন। এদের রূপে সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। এদেরকে বলা হয় আদিম জগতের বানর। হিমালয়ের আদিবাসীরা সোনালী বানরকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করে। কালো মুখের চারিদিকে বড় বড় সোনালী রং, বুকের রং একটু কালচে। এদের লেজ বেশ দীর্ঘ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের পরিবেশ থেকে সোনালী বানরের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে।
৩.হরিয়াল
অনেকটা পায়রার মতো দেখতে পাখি। গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায় আর ফল খায়। অনেকেই এদেরকে টিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। অনিন্দ্য সুন্দর এই পাখির রং গায়ের রং সবুজ। লেজ গোলাকার, পায়ের তলায় রয়েছে মাংসল পেশী। যার মাধ্যমে এরা সহজেই চলাচল করতে পারে। তবে বিভিন্ন রকমের হরিয়াল রয়েছে। মানুষের অত্যাচারে দিনের পর দিন কমছে হরিয়ালদের সংখ্যা। এদের নামও ভীষণ ইন্টারেস্টিং। যেমন দারুচিনি মাথা হরিয়াল, গোলাপি ঘাড় হরিয়াল, কমলা বুক হরিয়াল, ঠোঁট মোটা হরিয়াল, ধুসর গাল হরিয়াল, হলদে পা হরিয়াল।
৪. মায়াবি হরিণ
রামায়ণের মায়াবী হরিণের কথা কমবেশি সবাই জানেন। তবে বাস্তবেও মায়া হরিণের মধ্যে কম মায়া নেই। হরিণ প্রজাতির মধ্যে এরা অন্যতম খর্বকায় এবং লাজুক সদস্য। এরা মায়া হরিণ কিংবা কাকর হরিণ নামে পরিচিত। এদের চলাফেরা থেকে শুরু করে জীবনধারণ চমৎকার। মায়াবি হরিণ একটুতেই অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। শিকারি প্রাণী দেখতে পেলে অনেকটা কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে ডাকে। তাই এদেরকে বলা হয় বার্কিং ডিয়ার। এদের খাটো শরীর লালচে বাদামী লোম দ্বারা আবৃত। স্থান এবং ঋতুভেদে লোমের রঙের পরিবর্তন হয়।
৫.ঘুঘু পাখি
বর্তমানের শিশুরা ঘুঘু কিংবা চড়ুই পাখির কথা শুধুমাত্র বইতেই পড়বে। কিন্তু ঠিক কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর আগে যারা জন্মেছে, তারা জানেন ঘুঘু পাখি কি, কেমন ভাবে ঘুরে বেড়ায় কিংবা কিভাবে খাবার খায়। একসময়ের চিরপরিচিত পাখিটি আজ বিপদের মুখে। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহারে তাদের আবাসস্থল বিপন্ন।
৬.ধনেশ
শক্ত এবং লম্বা বাঁকানো ঠোঁটের জন্য বিখ্যাত ধনেশ পাখি। এরা প্রাকৃতিকভাবে গর্ত কিংবা পর্বতের গর্তে বাসা বাঁধে। এটি একমাত্র পাখি যার মেরুদন্ডের অ্যাটলাস ও প্রথম দুটি কশেরুকা একত্রে সংযুক্ত থাকে।
৭.সম্বর
হরিণ প্রজাতির মধ্যে বৃহৎ সদস্য হল এরা। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে এদের দেখা মেলে। এরা দীর্ঘ শিংয়ের জন্য বিখ্যাত। তাই এদের বলা হয় বড় সিংঘা হরিণ। একসময় এদের শিং দিয়ে ছোরার বাট, আগ্নেয়াস্ত্রের হাতল প্রভৃতি তৈরি হত। মানুষের সীমাহীন লোভ আর স্বার্থের জন্য এরা আজ মহা বিপদে।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম