।। প্রথম কলকাতা ।।
Bangladesh: মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশই কিন্তু মুসলিম প্রধান। যেখানে ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিংবা আধ্যাত্মিক , বাংলাদেশের সাথে বিস্তর মিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিতে বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা ঠিক কতটুকু? মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে বাংলাদেশের অবদান টা ঠিক কেমন? ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক? মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আয়, উন্নতি, সফলতা কিংবা অগ্রগতি সবেতেই বাংলাদেশের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু যখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ আসে, তখনই ওঠে একগুচ্ছ প্রশ্ন। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ খুবই কম। তাহলে কি মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না? কূটনৈতিক স্ট্র্যাটেজিতেই রয়ে গিয়েছে আসল গলদটা। বাংলাদেশকে কোন চোখে দেখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো?
মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের দূরত্বটা কম নয়, যে কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর উপরেই বাংলাদেশকে একটু বেশি নির্ভর করতে হয়। আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রেও কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে তার প্রতিবেশী দেশগুলোই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হলে, তার ভার বইতে হয় এশিয়ার এই দেশটাকে। বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করে নিতে বাংলাদেশ কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অন্যদের মতো বাংলাদেশকেও বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল। যদিও সেই খারাপ সময় কাটিয়ে, আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটা। মধ্যপ্রাচ্য সহ সব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক। তবে মধ্যপ্রাচ্যের নাম আসলেই একটা দেশের নাম বারংবার চলে আসে, তা হল সৌদি আরব। আর সেই সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দেখার মত। ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও উভয় রাষ্ট্রের অধিবাসীরা মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। নানান সংকটকালে সৌদি আরবের সরকার থেকে শুরু করে জনগণ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। দুর্যোগ কালে শর্তহীন ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিংবা কোভিড পরবর্তী বিভিন্ন দেশ যখন তার ভয়াবহ প্রভাব থেকে নিজেদেরকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সময় সৌদির সহযোগিতা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কাতারের সাথেও বাংলাদেশের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কে গত এক দশকে এসেছে বহু ইতিবাচক পরিবর্তন। যদিও আগাগোড়াই কাতার আর বাংলাদেশ বন্ধু প্রতিম দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ইস্যু, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোকে অভিন্ন অবস্থান থেকে দেখছে দুই দেশ। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাতার হয়ত আরো বড় ভূমিকা রাখবে। দুই দেশের কূটনৈতিক মহল আশা, বাংলাদেশ আর কাতার পারস্পরিক বিশ্বাস আর নির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এভাবেই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বলতে তো শুধুই সৌদি আরব, কুয়েত কিংবা কাতার নয়। যদি অন্যান্য দেশগুলোর কথা বলা হয় কিংবা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরিখে যদি বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা বলা হয়? তখন কিন্তু আমুল বদলে যাবে সেই অঙ্কটা।
গত একযুগের হিসেবে, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে মধ্যপ্রাচ্যের অবদান কিন্তু খুবই কম। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সেভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বিগত এক যুগে, বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ অর্থায়ন করেছে সাকল্যে এক বিলিয়ন ডলারের কম। আর সেখানে কিন্তু জড়িয়ে সৌদি আরব আর কুয়েতের নাম। আর ওদিকে ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছে। শুধু অর্থায়নই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুত অর্থের ছাড়ও কিন্তু এখন অনেকটা কমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের অনুকূলে অর্থছাড় ৪৭ মিলিয়ন ডলার। অথচ তারা আগের অর্থবছরে একই সময়ে অর্থায়ন হয়েছিল ৬২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দিনের পর দিন অর্থ ছাড়ের পরিমাণ কমছে। অথচ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিনিয়োগ কিংবা অর্থায়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশ কিছু তহবিল রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বিনিয়োগে সেগুলোর বড় ভূমিকা নেই। হয়তো, বাংলাদেশের বিষয়টা মধ্যপ্রাচ্যকে সেভাবে আকর্ষণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফান্ড রয়েছে, কিন্তু সেই ফান্ড থেকে যদি বিনিয়োগ পেতেই হয় তাহলে রাজনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদারের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা গুলোকে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি যথাযথ ব্র্যান্ডিংও করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে এখনো পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে সবচেয়ে বড় ঋণ অর্থায়ন এসেছে আইডিবির মাধ্যমে। তাই তো কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের যে ঋণ অর্থায়ন হয় তার পরিমাণ সত্যি ভীষণ অল্প। অথচ তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতে কাতার কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল পরিমাণে অর্থায়ন রয়েছে। প্রশ্নটা তো এখানেই। তাহলে কি মধ্যপ্রাচ্য এখনো বাংলাদেশকে সস্তা এবং অদক্ষ শ্রমশক্তির সরবরাহকারী দেশ হিসেবেই দেখে? নাকি মধ্যপ্রাচ্যের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই? সবটাই কি হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্ট্র্যাটেজির কারণে? কোথাও গিয়ে কূটনীতিতে অপেশাদারিত্ব রয়ে যাচ্ছে না তো? কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, সৌদির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হলেও সৌদিকে বড় প্রস্তাব দেওয়ার মতো কোনো প্রকল্প বাংলাদেশ হয়তো তৈরি করতে পারছে না। অথচ সৌদি বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রকল্প শুরু করতে বেশ আগ্রহী। আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়া হলেও, নানান জটিলতায় তা আটকে রয়েছে। হয়তো বা মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই।
অথচ খেয়াল করে দেখবেন, মধ্যপ্রাচ্যের সামান্য সংঘাতের এফেক্টও কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে পড়ে। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। আর তারা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যে প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন গড়ে পরিবহন হয় প্রায় ২ কোটি ব্যারেলের বেশি জ্বালানি তেল। সারা বিশ্বে যে তেল পরিবহন করা হয় এটি তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। তাই মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যদি সংঘাতে জড়ায়, তাহলে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি সংকটে পড়তে পারে। সেখান থেকে তখন বাদ পড়ে না বাংলাদেশও। আর তার থেকেও বড় কথা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হলো প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। যার বড় অংশ আসে শুধুমাত্র বাংলাদেশের মধ্যপ্রাচ্যে ছয়টি মুসলিম দেশ থেকে। এছাড়াও দেশটার পোশাক শিল্পে রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের উল্লেখযোগ্য অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তাই তো মধ্যপ্রাচ্যের সামান্য সংকটও ভাবিয়ে তোলে বহুযোজন দূরে থাকা এশিয়ার দেশ বাংলাদেশকে।
এমত পরিস্থিতিতেও উপায় একটাই। বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্যের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। দেশটার উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে মধ্যপ্রাচ্যকে ঠিক ভাবে বোঝাতে হবে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র সস্তা শ্রমের উৎস নয়, এটা বোঝানোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আরও জোরালো করতে হবে কূটনৈতিক যোগাযোগ। যাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী হন। যেখানে গুরুত্ব পাবে দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানি খাতে সহযোগিতার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি, রপ্তানি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে হ্যাঁ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে খারাপ এমনটা কখনোই বলা যাবে না। বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নীতিতে চলে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শক্ত। কিন্তু সৌদির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা শুধু শ্রম বাজারেই সীমাবদ্ধ নেই, তার বিস্তৃতি ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠিক ততটাই গভীর হওয়া দরকার।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম