।। প্রথম কলকাতা ।।
Bangladesh: দু পাড়ে সবুজ গাছের সারি, আর মাঝে জলের উপর ভাসছে প্রচুর নৌকা। এক একটা নৌকায় সাজানো কৃষকদের স্বপ্ন। ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁক ডাকে সরগরম হয়ে ওঠে জলের উপর ভাসমান হাট। জলে সমান তালে চলে বাহারি নৌকার বিকিকিনি। কথায় আছে ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল। ভাসমান বাজার দেখতে যারা ইতালি, চীন কিংবা থাইল্যান্ডে ছুটে যান তাদের মনের সাধ পূরণ করতে পারে বাংলাদেশের বরিশালের পিরোজপুর।
পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার খ্যাতি বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে। কুড়িয়ানা সহ আশেপাশের প্রায় ২২ টি গ্রামের ৮৫০ হেক্টর জমিতে প্রায় ২০ হাজার ২৫টি পেয়ারা বাগান আছে। এখানে মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস হল সুমিষ্ট পেয়ারা। শুধুমাত্র পেয়ারা কেনার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এই ভাসমান হাটে ছুটে আসেন। পেয়ারার হাটকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যদিও শুধু পেয়ারা নয়, পিরোজপুরের ভাসমান হাটে মরশুমি সমস্ত রকম শাকসবজি পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষই কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাই তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য এই ভাসমান হাট তৈরি হয়েছে। বিক্রেতারা নৌকা সাজিয়ে তাদের কৃষিজ পণ্য নিয়ে ভাসমান হাটে চলে আসেন। তারপর দূর থেকে ক্রেতা ডাক দিলেই চলে যান তাদের কাছে। ভাসমান হাটের বেশিরভাগ ক্রেতাই হন পাইকাররা। তারা নিয়ে আসেন বড় ইঞ্জিন বোট, সেখানে প্রচুর পণ্য একসঙ্গে কিনে জড়ো করেন। কখনো বা কেনেন কেজি দরে, আবার কখনো বা নৌকা ধরে। সেই পণ্য চলে যায় বাংলাদেশের বড় বড় শহরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্রেতা বৈঠা নৌকা ব্যবহার করেন, কারণ জিনিস বিক্রি করতে অনেক সুবিধা হয়।
পিরোজপুরে এইরকম ভাসমান প্রচুর হাট রয়েছে। শুধু সবজি নয় কখনো বা ফল আবার কখনো বা চালে ছোট ছোট নৌকার খোল ভরে ওঠে। তারপর সন্ধ্যা নদীর বুক জুড়ে ঘুরে বেড়ায় ছই ছাড়া সার বাঁধা নৌকা। বিশেষ করে যদি শীতে পিরোজপুরে যান, তাহলে অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আপনার মন ভুলিয়ে দেবে। নৌকার আরোহীরা শীতের সকালের মিঠেকড়া রোদ সামলাতে কেউবা মাথায় গামছা বেঁধে বসে আছেন, আবার কেউ বা মাথায় রেখে দিয়েছেন একটি ছাতা। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। কেউ দরদাম করতে করতে লগিতে ভর দিয়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন পাইকারের বড় নৌকার দিকে। দরদাম মিলে গেলে ছোট্ট নৌকা থেকে জিনিস চলে যাবে পাইকারদের নৌকায়। অসংখ্য ছোট নৌকার চলাচলে সন্ধ্যার বুক জুড়ে জলরাশি খুশিতে দোল খায়। সন্ধ্যার পর ক্রেতা বিক্রেতা একে একে নদী কিংবা খাল ছেড়ে যে যার ঘরে ফিরে যান। তখন শান্ত নিঝুম পরিবেশের মধ্যে পড়ে থাকে একাকী ভাসমান হাট।
ক্রেতা বিক্রেতাদের খিদে মেটাতে খাল কিংবা নদীর দু’পাশে প্রচুর খাবারের দোকান রয়েছে। একসময় সন্ধ্যা নদীর ঐতিহ্যবাহী ধান চালের ভাসমান হাটের বেশ নাম ডাকছিল। বর্তমানে তার জৌলুস ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর সীমাবদ্ধতা আর ধান চালের ব্যবসা অন্যত্র স্থানান্তর হয়ে যাওয়ায় এই হাট এখন মহা সংকটে। একসময় বরিশালের বালাম চালের যে সুখ্যাতি ছিল তা আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে। স্বাভাবিকভাবেই দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ী কৃষকরা এই চালের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ এই চালের বাজারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বরিশালের প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। পিরোজপুরের অসংখ্য ভাসমান হাটে চালের বাজারে ভাটা পড়লেও অন্যান্য সবজি বাজারে এখনো পর্যন্ত লাভের ধারা অব্যাহত। বিশেষ করে পেয়ারার বাজার মানেই রমরমিয়ে বেচাকেনা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের স্বরূপকাঠির পেয়ারা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। অনেকে এই পেয়ারাকে বলে থাকেন বাংলার আপেল। যার কারণে এই পেয়ারার ভাসমান হাট অন্যান্য হাটের থেকে একটু বেশি স্পেশাল। জুন থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই মাস বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করা হয়। তারপর ভাসমান বাজারে নৌকায় করে পেয়ারা বিক্রি করতে নিয়ে আসেন কৃষকরা। সেই পেয়ারা বড় ট্রলার, লঞ্চে করে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
ভাসমান বাজার মানেই সেখানে ক্রেতা বিক্রেতা আসবেন। স্বাভাবিকভাবেই নৌকার প্রয়োজন অনেক। বরিশাল, পিরোজপুর এবং ঝালকাঠি জেলার মানুষের নৌকার চাহিদা মেটাতে প্রায় একশ বছর আগে পিরোজপুরের আটঘরে কৃষি পণ্যের ভাসমান হাট ও ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাটের গোড়া পত্তন হয়েছে। কুড়িয়ানা খালের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে শুধুমাত্র কৃষি পণ্যের ভাসমান হাট বসে কিন্তু নৌকার হাট বসে শুধুমাত্র আটঘরে। ১০০ বছরের পুরনো এই হাট বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে সবথেকে বড় নৌকার হাট হিসেবে পরিচিত। এখানে গেলে দেখতে পাবেন প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে খালের দক্ষিণ প্রান্তে আর সড়কে শত শত নৌকা সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। জলের ঢেউয়ের তালে চলছে নৌকা কেনাবেচা। এই নৌকা করেই বিক্রি করা হয় পেয়ারা, আমড়া, কলা, নারকেল, সুপারি সহ নানান ধরনের শাকসবজি। এছাড়াও মাছ ধরা কিংবা গোখাদ্য সংগ্রহেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এ যেন এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। অনেকে আবার নৌকা কিনতে নয়, শুধুমাত্র এই ঐতিহ্যের অংশ হতে ভিড় জমান। সব থেকে বড় ভাসমান শাক সবজির হাট হিসেবে ধরা হয় পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা হাটকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে লঞ্চে ট্রলারে কিংবা বড় নৌকায় করে চলে যান ঢাকা বরিশাল সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর বন্দর কিংবা গ্রামের হাট বাজারে । এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপের বাজারেও এই বাজারে কৃষি পণ্য রপ্তানি করা হয়। সড়ক যোগাযোগের অবকাঠামোর উন্নতি ঘটলেও শতবর্ষের এই জনপদে এখনো বাসিন্দাদের যাতায়াতের অপরিহার্য অঙ্গ হলো নৌকা। বর্তমানে প্রচুর নানান ধরনের যান্ত্রিক নৌকার প্রচলন করলেও এখনো এখানকার মানুষের ঘরে ঘরে একটি করে বৈঠা চালিত নৌকা রয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে ও ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাতায়াত বেড়ানো সাধারণ চলাফেরা চাষাবাদ রক্ষণাবেক্ষণ সবকিছুতেই যেন জড়িয়ে রয়েছে নৌকা, যা ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। রাজধানী ঢাকা থেকে বেশি দূর নয়, ১৬১ কিলোমিটার দূরে গেলেই আপনি পেয়ে যাবেন আটঘর কুড়িয়ান ইউনিয়নের বুক জুড়ে সন্ধ্যা নদীর ভাসমান হাট।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম