।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran-Iraq: চরম শত্রুতার তিক্ততা ভুলে আবার কাছাকাছি ইরান আর ইরাক। বন্ধুত্বের দাম দিতেই কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলেন ইরাকের ধর্মীয় নেতা? মধ্যপ্রাচ্যের এত সংকটেও ইরাক চুপ ছিল, কিন্তু আর নয়। এবার মুখ খুললেন ইরাকের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল সদর। ইরানের সাথে ইরাকের শত্রুতা মিটলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরাক এখনো কেন এত শত্রুতা জিইয়ে রেখেছে? রাফায় ইসরায়েলের হামলা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ল ইরাক দেশটা। ব্যাপারটা কী? বিগত সাত মাস ধরে হামাস আর ইসরায়েলের যুদ্ধ চলছে, তাহলে এতদিন ইরাক কোথায় ছিল? মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটে বেশিরভাগই দেশ কিন্তু কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইরাকের চুপ থাকার কারণটা টা কী? ইসরায়েল নয় বরং হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করল যুক্তরাষ্ট্রের উপর। ইরাক, ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র, এই তিন দেশের মধ্যে শত্রুতার আর বন্ধুত্বের ইতিহাস একটা সময় নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্ব রাজনীতির ভীত। একবার ইরান আর ইরাক এক হয়ে গেলে, মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে কোনঠাসা হয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র আল ইসরায়েল।
ইসরায়েলের রাগ যুক্তরাষ্ট্রের উপর মেটাচ্ছে ইরাক, সংঘাতে নতুন মোড়
হামাসের হামলার পাল্টা জবাব দিতে গত সাত মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে। টার্গেট কিন্তু হামাস। কিন্তু মাঝখান দিয়ে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজার একটা আশ্রয় শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় কয়েক ডজন বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছেন। আর এই ঘটনায় ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রের উপর রাগ মেটালো ইরাক। ইসরায়েল নয়, বরং এই হামলায় প্রতিক্রিয়ায় একটি বিবৃতি পোস্ট করে ইরাকের ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল সদর সমালোচনা করে বলেন, গাজায় যে কর্মকাণ্ড চলছে সেখানে নির্লজ্জ সমর্থন দিচ্ছে ওয়াশিংটন। তিনি ইরাকের বাগদাদ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার সহ রক্তপাত ছাড়া কূটনৈতিক কৌশলে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। অপরদিকে ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথায়, ইসরায়েল নিজের দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বন্ধ করতে এবং ইসরায়েলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আহ্বান জানিয়েছে ইরাক।
কিন্তু ইরাক এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরে ইরাকের ধর্মীয় নেতার কথা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জোড় সমালোচনা। বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস থাকবে নাকি থাকবে না, এই প্রশ্নটা বহুদিনের। ইরাক কিন্তু কখনোই চায় না, বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস থাকুক। শুধু তাই নয়, এর বিরোধিতাও করেছে। যার নেপথ্যে কাজ করছে তীব্র রক্তাক্তের ইতিহাস। একটা সময় মিলিশিয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া ধর্মীয় নেতা এই মুকতাদা আল সদর। আগাগোড়াই তিনি মার্কিন বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। ২০০৩ সালের পরবর্তীকালে তিনি মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু মূল সমস্যাটা কি বলুন তো, ইরাকের তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। দেশটার অভ্যন্তরে এই নেতার রয়েছে লক্ষ লক্ষ অনুসারী। শুধু তাই নয়, ইরাকের জাতীয় রাজনীতিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যদি তিনি এভাবেই বারংবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধচারণ করেন, তাহলে দেশটার অভ্যন্তরে বেশ চাপে পড়বে মার্কিন দূতাবাস। আর সেটাই হচ্ছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করার জন্য ইরাকের নতুন অস্ত্র, গাজায় ইসরায়েলি হামলা।
শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বের নীতিতে ইরান আর ইরাক! ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্রের মাস্টারপ্ল্যান
২০০৩ সালে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর মিত্রদের নিয়ে ব্যাপক হামলা চালায় ইরাকে। ক্ষমতাচ্যুত করে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। পাশাপাশি দেশটাতে চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। যদিও ২০১১ সালে মার্কিন সেনাদের ইরাক থেকে প্রত্যাহার করা হয়, কিন্তু ঠিক তার তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৪ সালে সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ইরাকে প্রভাব বিস্তার করলে তাদের দমনে আবার ফিরে আসে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা। মোটামুটি ভাবে নিজের দেশের অভ্যন্তরে মার্কিনী কোন প্রভাবই যেন সহ্য করতে পারে না ইরাক। এইতো গত বছরের কথা, যখন তেহরানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট আব্দুল লতিফ রশিদ। তখন খামেনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র নাকি কারো নির্ভরযোগ্য কোনো বন্ধু হতেই পারেনা।
ইরাকের মাটিতে কোন মার্কিন সেনাকেই থাকতে দেওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বন্ধু নয়। এমনকি তারা তাদের ইউরোপীয় বন্ধুদের প্রতিও বিশ্বস্ত নয়। ইরাকের মতোই ইরান প্রতিবেশী এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি চরম বিরোধী। খামেনির মতে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের অন্যতম কারণ, পশ্চিমী দেশগুলোর সেনাদের হস্তক্ষেপ। ইরান আর ইরাক একসময় দীর্ঘ ৮ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল, যেখানে বড় মাস্টারমাইন্ড এর কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর আজ সেই ইরাক আর ইরান মেতেছে বন্ধুত্বের নীতিতে। আর চাপে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান আর ইরাক কিন্তু নিজেদের মতো করে সম্পর্কের ক্ষত পূরণে ব্যস্ত। দুই দেশই নিজেদের সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ সচেতন।
ইরাক-ইরানের গভীর ক্ষতে প্রলেপ, রুখে দাঁড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
যদি মধ্যপ্রাচ্যের কুটনৈতিক রাজনীতির দিকে দেখে তাকান, দেখবেন কে যে কখন কার বন্ধু হয়েছে, আর কে যে কার কখন শত্রু হয়েছে, তা বোঝা মুশকিল। আজ যে ইরাক আর ইরান বন্ধুত্বের সম্পর্কে রয়েছে, একটা সময় ছিল এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মেতেছিল। শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালে। ১৯৮০ সালে ইরাকি সুপ্রিম লিডার সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করলে সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, চলে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে চলা যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণ। বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল দুই দেশের মধ্যে থাকা রাজনৈতিক আর সামরিক বিরোধ, যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর। একদিকে যখন ইরাকে ক্ষমতায় আসছেন সাদ্দাম হোসেন, অপরদিকে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের ক্ষমতায় আছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে কখনোই বন্ধুত্ব ছিল না।
বলা হয়ে থাকে, এই যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়েই নাকি সৌদি আরব, কুয়েত তার প্রতিবেশী বহু আরব রাষ্ট্র সরাসরি ইরাককে সমর্থন করেছিল। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত কৌশলভাবে দাঁড়িয়েছিল ইরাকের পাশে। আবার অপরদিকে সিরিয়া, লিবিয়া ছিল ইরানের পক্ষে। তবে এই যুদ্ধে কুর্দি গণহত্যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরাকের আর সাদ্দামের ভাবমূর্তি। পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে ইরাকের তৈরি হয় একটা বিস্তর দূরত্ব। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য সরাসরি সাদ্দামকে দায়ী করেছিল।। অপরদিকে সাদ্দাম সেই অভিযোগ অস্বীকার করে তার দায় চাপিয়েছিল ইরানের উপর। ১৯৮৮ সালে যখন দুই দেশ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, অর্থনীতি পৌঁছে যায় একদম ভাঙনের দোরগোড়ায়, তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হয় ইরান। অপরদিকে ইরাক যুদ্ধ বিরতির জন্য মেনে নেয় ইরানের দেওয়া শর্ত সমূহ। ইরান থেকে সকল সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। যার মধ্যে শেষ হয় ৮ বছরব্যাপী ইরাক ইরান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কিন্তু কোনো পক্ষই জয়ী হয়নি। কারণ যে লক্ষ্য নিয়ে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, তার বেশিরভাগটাই অপূর্ণ থেকে যায়। পাশাপাশি কোন দেশেই প্রতিপক্ষের সরকারের পতন ঘটেনি। উল্টে স্থবির হয়ে গিয়েছিল দুই দেশের ক্রমশ বর্ধমান অর্থনীতির চাকা। সেই জায়গা থেকে কিন্তু আজ দুই দেশ বন্ধুত্বের নীতিতে চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছে, আর অপরদিকে পুরোপুরি ভাবে কালপ্রিট বানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
ওদিকে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের কথা তো জানেনই। যার জেরে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য। ইরানের খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে, তেহরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, পারমাণবিক শক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষাস সহ মধ্যপ্রাচ্যে উভয় রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের আগ্রহ থাকায় এই দুই দেশের মধ্যে বিগত পাঁচ দশক ধরে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তা এখন গোটা বিশ্বব্যাপী আলোচনা এবং ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ শুনলে আশ্চর্য হবেন, আজ যে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরান একে অপরকে চরম শত্রুভাবে, একসময় তাদের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। প্রায় দীর্ঘ ২৬ বছর ছিল সেই বন্ধুত্ব। কিন্তু আসলে কি বলুন তো, স্বার্থকেন্দ্রিক এই বিশ্ব রাজনীতিতে সম্পর্কের উত্থান কিংবা পতন অনেকটা রাত আর দিনের বদলের ঘটনার মতো। ১৯৭৯ সালে খামেনি ক্ষমতায় আসার পর, সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইরান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলকে। ১৯৯০ সালের পর থেকে ইসরায়েল অভিযোগ করে আসছে, ইরান নাকি পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে, আর এই পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতেই, সেই যে শত্রুতার তিক্ততা শুরু হলো, তা এখনো মেটেনি। এবার মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত পুরনো সংঘাতকে নতুন করে উসকে দিচ্ছে হামাস আর ইসরায়েল দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে পারে ইরান আর ইরাক।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম