।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran-India relations: ভারত আর ইরানের মধ্যে হয়ে গেল বড় চুক্তি। আর তা দেখেই যেন নজর লাগছে যুক্তরাষ্ট্রের। রীতিমত হুঁশিয়ারি দিয়ে বলল, এর ফল ভালো নাও হতে পারে। ইরানের পাশে থাকার কারণে ভারতকেও পড়তে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে। যে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার ভারতকে মিত্র রাষ্ট্র বলে দাবি করে এসেছে, সেই যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ ভারতের বিরুদ্ধে যাচ্ছে কেন? ইরানের সাথে যে যে দেশ হাত মিলিয়েছে, সেই সমস্ত দেশের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল। তাহলে কি এবার ভারতের পালা? ভারত-ইরানের চুক্তি বদলে দিতে পারে বৈশ্বিক ভূরাজনীতি। এটা একটা বড় চাল। সোজা কথায়, এক ঢিলে দুই পাখি। একটা চুক্তিতে ভারতের কাছে জব্দ পাকিস্তান আর চীন। কিন্তু কীভাবে? মধ্যপ্রাচ্যে আরো পাকা হচ্ছে ভারতের ঘুঁটি, আর তাতেই কি এত রাগ যুক্তরাষ্ট্রের? বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ইরান।
ভারত-ইরান চুক্তিতে তেলেবেগুনে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্র
ভারত আর ইরান চুক্তিতে তেলে বেগুনে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই হয়ত নিষেধাজ্ঞার এই হুঁশিয়ারি। ইরানের চাবাহার বন্দর বৈশ্বিক বন্ধুত্বের সমীকরণটা বদলে দিতে পারে। তাহলে কি সেই ভয়টাই পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে চাবাহার বন্দর নিয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে নয়া দিল্লি। তারপরেই যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এল হুঁশিয়ারি বার্তা। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের কথায়, কেউ যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসার কথা ভাবে, তাহলে কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে। অর্থাৎ তিনি সরাসরি ভারতের নাম না করে বুঝিয়ে দিলেন, ভারতের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কে বন্ধু রাষ্ট্র, আর কে শত্রু রাষ্ট্র, তা বিবেচনা করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইরানের সঙ্গে কেউ ব্যবসা করার কথা ভাবলে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তার আগে থেকেই সজাগ থাকা উচিত। চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারত আর ইরানের যে চুক্তি হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালোভাবে জানে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ভারতের বিদেশ নীতি নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই। কারন এই চুক্তি ইরান আর ভারতের সম্পর্কের আওতায় পড়ে। কিন্তু যেহেতু ইরানের উপর এখনো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, সেই নিষেধাজ্ঞা ভবিষ্যতেও জারি থাকবে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, সবটা জেনে কেউ যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করার কথা ভাবে, তাহলে সেই দেশের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। আর সেই কথাটা যেন তারা মনে রাখে। এমন বক্তব্যে খুবই স্পষ্ট, এটা ভারতের উদ্দেশ্যে পরোক্ষভাবে একটা বড় হুঁশিয়ারি।
যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ডোন্ট কেয়ার, ইরানের সাথে বন্ধুত্বে ভারতের লাভ
প্রশ্নটা হল, এই যে যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, এটা নিয়ে ভারত কী ভাবছে? আদৌ কি এই হুঁশিয়ারি নিয়ে ভারতের ভয় পাওয়ার কোন কারণ রয়েছে? এই প্রথম নয়, এর আগেও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের মিত্রতার কারণে নয়া দিল্লিকে এমন হুঁশিয়ারি কিংবা সতর্কবার্তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তবে ভারত সেগুলোকে পাত্তা দেয়নি। যখন রাশিয়া থেকে ভারত এস ৪০০ মিসাইল সিস্টেম কিনেছিল, তখনো একইভাবে দিল্লিকে হুঁশিয়ারি দেয় ওয়াশিংটন। যদিও ভারত তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। বরং এস ৪০০ মিসাইল সিস্টেম কিনেই ছেড়েছিল। এবারেও যে ভারত সেই নিষেধাজ্ঞার কথা শুনবে না, তা বলাই বাহুল্য। কারণ ইরানের সঙ্গে চুক্তি ভারতের রাজনৈতিক স্ট্যাটিজিতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টেপ। যেভাবে দিনের পর দিন ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার জন্য চীন বাণিজ্যিক করিডোর তৈরির পরিকল্পনা করছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে চীনের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারে ভারত- ইরানের চুক্তি।
কারণ শি জিনপিং-এর স্বপ্নের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভের অংশ হল চীন-পাক অর্থনৈতিক করিডোর। যার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে জড়িত বালুচিস্তান প্রদেশের গদর বন্দর। এবার কিন্তু এই বন্দর আর ভারতের গলার কাঁটা হতে পারবেনা। ইরানের সঙ্গে ভারত চাবাহার বন্দর নিয়ে যে ১০ বছরের চুক্তি করেছে, তাতে এখন চীনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা। চুক্তি অনুযায়ী, চাবাহার বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে ভারতের উপর । যার মাধ্যমে আফগানিস্তান সহ মধ্য এশিয়া এমনকি ইউরোপের সঙ্গে ভারত সহজে যোগাযোগ রাখতে পারবে। ইরান আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পণ্য পরিবহন হবে আর সহজ। সহজ কথায়, ইরানের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া আর মধ্য এশিয়ার মধ্যে ভারতের সামনে খুলে গেল একটা নতুন বাণিজ্যক রুট। গদর আর চাবাহার বন্দরের মধ্যে সড়ক পথে দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটার। আর সমুদ্র পথের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চাবাহারকে যুক্ত করা হবে, ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের সাথে। যারা আওতায় রয়েছে ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের জাহাজ রেল সড়কের প্রায় ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নেটওয়ার্ক।
চাবাহার বন্দর চুক্তি আজকের নয়, বহুদিন ধরেই ইরানের ভারতের মধ্যে চলছিল আলোচনা। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইরানে গিয়ে এই চুক্তি করেছিলেন। তারপর ২০১৮ সালে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আসেন ভারতে। যেখানে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে চাবাহারের উন্নতি নিয়ে নানা আলোচনা হয়। তারপর চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে ফের ইরানে যান ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। অবশেষে বহুদিনের দীর্ঘ আলোচনা, জল্পনা এবং অপেক্ষার নিরসন ঘটিয়ে সম্প্রতি ইরানের মাটিতে দাঁড়িয়ে চূড়ান্তভাবে স্বাক্ষরিত হল চাবাহার বন্দর চুক্তি।
ভারতের উপর ভরসা ইরানের, কী চাইছে যুক্তরাষ্ট্র?
আসলে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে যে ভারত সরকার তার বিদেশনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিস্তারিত জানাক। ইরানের সঙ্গে ভারতের যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, চাবাহার বন্দর নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সেসব নিয়ে নাকি ভারতের কথা বলা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, যারাই ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করবে, তাদের মনে রাখা উচিত, তারা নিজেরাই নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পথ খুলে দিচ্ছে। এ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়, ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখায় ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপালেও চাপাতে পারে জো বাইডেনের দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা প্রসঙ্গে, ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফ থেকে এখনো অফিশিয়ালি কিছু জানানো হয়নি। আসলে কি বলুন তো, ভারত চলে নিজস্ব নীতিতে। ভারতের ফার্স্ট প্রায়োরিটি নিজের জাতীয় স্বার্থ এবং দেশের মানুষ। সেক্ষেত্রে যে দেশের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থের জন্য ঠিক, সেই পথেই চলবে ভারত। বছর ছয়েক আগে, ভারতে ইরানের তেল সরবরাহ নিয়েও কিন্তু নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। তখনও জলঘোলার মূল কারিগর ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ইরান থেকে তেল নেওয়া বন্ধ করলেও, দুই দেশের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করে দিলে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অধঃপতন ঘটে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো, সেই সূত্রে ইরান চেয়েছিল এই পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরানোর ক্ষেত্রে তৎপর হোক নয়া দিল্লি। পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারত বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করেছিল ইরান। ট্রাম্প এই চুক্তিতে না ফিরলেও, এ থেকে বোঝা যায় ভারতের উপর ইরানের ভরসা কিন্তু কম নয়।
সারমর্মে এটাই বলা যায়, দিনের পর দিন গোটা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র কাজে লাগাচ্ছে, তা ভোতা হতে আর বেশি দেরি নেই। কারণ একের পর এক দেশ সেই নিষেধাজ্ঞার বোঝা নাকচ করে সামনে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেক দেশেরই একটা করে নিজস্ব পররাষ্ট্র নীতি থাকে। আর সেই জায়গা থেকে বন্ধু রাষ্ট্র নয়, বরং নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থটাই আগে ভাবা উচিত বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। এই সহজ অঙ্কটাই বুঝতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু নিষেধাজ্ঞার বুলিতে ওয়াশিংটন নিজের সম্পর্কে ভূরাজনীতিতে তৈরি করছে একটা খারাপ ধারণা।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম