।। প্রথম কলকাতা ।।
১৫ই আগস্ট ভারতবাসীর কাছে গর্বের দিন, জয়ের দিন। কিন্তু সত্যিই কি স্বাধীনতার দিনটা আনন্দের ছিল? একদিকে উড়েছিল স্বাধীনতার পতাকা, অপরদিকে রাস্তায় মরছিল অসহায় মানুষ। ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল দেশ। যা ছিল বাঙালির কাছে যন্ত্রণাময় অধ্যায়। কাগজে-কলমে ভাগ হয়ে যায় এপার বাংলা, ওপার বাংলা। সেদিন বাঙালিদের অবস্থা জানলে চোখে জল ধরে রাখতে পারবেন না। কিন্তু আজও দুই বাংলার মধ্যে নাড়ির টান।
১৯৪৭ সালের ৩ই জুন, বড়লাট মাউন্টব্যাটেন ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন। সেদিন স্বাধীনতার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে ভারতবাসী। কিন্তু তার পিছনে ছিল বুক ভরা হতাশ, আর জমে থাকা কান্না। একই দিনে ঘোষণা হয়েছিল ভারত ভাগের কথা। ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়ে যায় ভারতের স্বাধীনতা আইন, যার অধীনে ১৫ ই আগস্ট ভারত পায় স্বাধীনতা, আবার অপরদিকে ঐক্যবদ্ধ ভারত ভাগ হয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটো আলাদা রাষ্ট্রে। পাকিস্তানের অংশে পরে বেলুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছুটা অংশ, পশ্চিম পাঞ্জাব আর পূর্ববঙ্গ। অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে তৈরি হয় স্বাধীন ভারত। সেদিনের পাকিস্তানে আবার দুটো ভাগ ছিল। একটা পশ্চিম পাকিস্তান আর একটা পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গ আজকের বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু এসেছিল একবারই, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী স্রোত বজায় ছিল ১৯৭১ পর্যন্ত।
সেদিন ভাঙন দেখা দেয় বাঙালিদের মধ্যে, বড় হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। আদতে দেশভাগ একটা গভীর ক্ষত। দাঙ্গা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে সেদিন কি না হয়নি। সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। প্রায় এক কোটি মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছিল। পরবর্তীকালে আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের দেশ ছেড়েছেন। কেউ ট্রেনে, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউনদী পথে, যে যেমন পেরেছে ভারতে চলে এসেছে। ভেঙে গিয়েছে হাজার হাজার পরিবার। জনশূন্য হয়ে পড়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আর পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেশি ছিল।
সেদিন মানুষের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ, বলে বর্ণনা করা যাবে না। শিয়ালদা হাওড়ার মতো স্টেশনে, খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাতে দিন কাটাতে থাকে সব হারানো সেই মানুষগুলো। আশ্রয় শিবিরের কথা নাই বা বললাম। মানুষের দিন কাটত অনাহার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কখনো বা অর্ধাহারে। ভিক্ষুকের মতো রাস্তায় ঘুরলেও রাস্তাটাও ছিল না সুরক্ষিত। যখন তখন বেঁধে যাচ্ছিল দাঙ্গা। পুনর্বাসনের নামে বহু মানুষকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেই সুদূর আন্দামানে। যাদের না ছিল মাথার উপর ছাদ, না ছিল নূন্যতম খাবার। একে নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ, তার উপর এত বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর আর্থিক দায়ভার, কে নেবে? সমস্যা মেটাতে সেই সময় ভারত এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দিল্লি চুক্তি হলেও সমস্যা মেটেনি। স্বাধীনতার পর ৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করতে। তাই তো স্বাধীনতা আমাদের কাছে যতটা গর্বের, দেশভাগ ঠিক ততটাই লজ্জার। দেশ ভাগ হলেও দুই বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে প্রচুর মিল। ব্রিটিশরা দেশ ভাগ করেছিল ঠিকই, কিন্তু বাঙালির ভালোবাসায় কোন ভাঙন ধরাতে পারেনি।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম