।। প্রথম কলকাতা ।।
Bangladesh: “মার্কিন ভিসা নীতি” বাংলাদেশের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে এখন আলোচনার হট টপিক। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সর্বত্রই আলোচনা সমালোচনার ঝড়। কিন্তু, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে? আদৌ কি এটা ভিসা নীতি, নাকি বাংলাদেশে “ভিসা আতঙ্ক” তৈরি করল যুক্তরাষ্ট্র? মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির তাৎপর্যকে কোন কোন ধারায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে? পদ্মার ওপারের মানুষ কি বলছে? চীনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ, ইনসিকিউরিটি থেকেই কি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রেডি টু টেক অ্যাকশন’ নীতি? খাঁটি কথা কিনা আপনারাই বলবেন। বাংলাদেশ বলছে, প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম, এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানে সুপার পাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সারা বিশ্বে রয়েছে। তারা দুনিয়ার মোড়ল, তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক কাজ করে, করবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন, এই দেশের স্বার্থ রক্ষার কাজ সরকার করবে এটাই স্বাভাবিক।
সত্যিই তো, ভেবে দেখুন ভারতের ক্ষেত্রে তো লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ নিজেদের মতামত পোষণ করতে আসে না। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে। অথচ এটা তো ঠিক বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে, একটা অন্য দেশ, গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল টাইপের আচরণ করছে কেন? একটু পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম যাঁরা জানতো, তাঁরা বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের নামও জানত। কিছুটা “মোড়ল” হিসেবেই জানত। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এই দুটো জায়গাকে প্যারালালি রেখে গুরুত্ব দেয়, দিয়ে এসেছে।
আর তাই যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বা যে কোনো ধরনের ডোমেস্টিক পলিটিক্সের ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে নাক গলানোর প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো সেই জায়গা দিয়েছিল বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসকে। কিন্তু এক দশক ধরে ছবিটা পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লগিরির ছত্রছায়া থেকে বাংলাদেশের মানুষ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ধরে রাখা জায়গা হেলায় হারাতে নারাজ। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি নিয়েই এখনো এগোতে আগ্রহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারই, প্রতিফলন ঘটলো বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ভিসা নীতিতে। বিষয়টা অনেকটা এরকম নয় কি?
স্কুলের শিক্ষক, বাড়ির বা পাড়ার মুরব্বিরা বলতেন “বাচ্চারা, ভালো না হলে চকলেট পাবে না”। যুক্তরাষ্ট্র যেন এখন সেই মুরব্বিদের মতোই। তারা বলছে ভালো একটা নির্বাচন করো, না হলে সেই চকলেটের মতো, আমেরিকান ভিসা পাবে না। আর, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যাঁদের এই ‘চকলেটের’ দিকে নজর, তারা গা ঝাড়া দিয়েছেন, দিচ্ছেন আর দেবেনও। কারণ এটা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকার গোষ্ঠীর কাছে বিদেশে চাকরি একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছে, থাকার ইচ্ছে, চাকরির ইচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে “স্বপ্ন”। বুদ্ধি করে সেই জায়গাটাতেই ডিরেক্ট কোপ মেরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ঘা তো লাগবেই। আর ঠিক এই কারণেই মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে বাংলাদেশ জুড়ে একটা চাপা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি এই নিষেধাজ্ঞাকে সত্যিই প্রয়োগ করে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই তা দুঃস্বপ্নের হবে।
এই বর্তমান সরকার কেন যাচ্ছে না? এ নিয়ে প্রহর গুনছেন যাঁরা, তাঁরা হয়তো খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন একটা কথা মাথায় রাখা উচিৎ যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। ফলে, বুঝতে হবে এই নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিন্তু প্রযোজ্য। ঠিক ধরেছেন, অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা প্রাক্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারের সমর্থক যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনই বিরোধী দলের সদস্যরাও কিন্তু বাদ এর খাতায় নন। এমনকি, এই ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। তাই বিরোধীদেরও এত খুশি হওয়ার কারণ যে নেই তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার নেপথ্যে বিরোধীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনের ঘটনা, বিশেষ করে র্যাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিরোধীরা। বিরোধীদের দাবি, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হোক, অনুকূল পরিস্থিতি বজায় থাকুক। সেক্ষেত্রে বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, যদি সেই পরিস্থিতি থাকতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের নতুন নীতি ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করত না, এ নিয়ে আলোচনারও দরকার হতো না। কিন্তু, বিএনপির নেতাদের আন্দোলন সহ সমমনা দলগুলোর একের পর এক অভিযোগের কারণে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে, মুখে মুখে কথায় কথায় বাংলাদেশের এই অবস্থার কথা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ফলে সেই ফায়দাটাই লুটতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি তো বলছে, তাঁদের আন্দোলন এর পটভূমিতেই বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই ভিসা নীতি থুড়ি ভিসা আতঙ্কের দুশ্চিন্তা আর ঝুঁকি কোনটাই এড়িয়ে যেতে পারছে না বিরোধীরাও। আসলে, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির তাৎপর্যকে একাধিক ধারায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যেমন
- বাংলাদেশ জুড়ে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, হবে
- সুশীল সমাজের যে অংশ সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করত, অবধারিত তাদের রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আসবে।
- এই নতুন ভিসা নীতির শক্ত বার্তার কারণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ সহ সবাই শঙ্কিত থাকবে। সংযত থাকবে বিরোধীদের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়া থেকেও।
- মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে, ফলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে আসতে পারে।
- বিগত বছরে সৌদি আরবকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানতম রেমিট্যান্স উৎস হয়ে উঠেছে, সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে আসতে পারে।
- নতুন ভিসা নীতির পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের ভবিষ্যতেও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
- আর অবশ্যই ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণে নতুন মোড়।
কিরকম? শুরুতে যে ইনসিকিউরিটির কথা বলা হয়েছিল শেষটাও সেখানেই। চীনের সাথে রেষারেষিতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোকে দলে টানার চেষ্টায় রয়েছে আমেরিকা। জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চার দেশীয় জোট কোয়াডে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ রয়েছে বলে নানা সময় খবর বেরিয়েছে। এর কারণ, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের ওপর যেভাবে নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ, সেটাও আমেরিকা ভালো চোখে দেখছে না। তাই বাংলাদেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা একবারও ভাবছে কি? যদি আমেরিকার বেশি চাপে চীনের দিকে বাংলাদেশ আরও ঝুঁকে পড়ার পাল্টা কৌশল নেয়, তাহলে? এখন মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা সামলানোর উপায় ঠিক কিভাবে আবিষ্কার করতে পারে হাসিনা সরকার? সেই কৌশলটাই দেখার অপেক্ষা।
উল্লেখ্য, অতীতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সহ মার্কিনিদের দাদাগিরি খর্ব করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের, যদি তার পুনরাবৃত্তি হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আতঙ্ক দেখানোর যে উদ্দেশ্য তা খুব একটা সফল হবে না। তবে বলাই বাহুল্য, এর ভিন্নমতও দেখা দিয়েছে প্রবলভাবে।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম