।। প্রথম কলকাতা ।।
Iran United States Conflict: মার্কিন ইরান উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ইঁটের বদলে পাটকেল নীতি ইরানের। কখনও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটক করছে, তো কখনও ইরান এর পাল্টা দিচ্ছে। কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে ইরান? কেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সংঘাতে নিষেধাজ্ঞা একটা বড় ফ্যাক্টর? এই দুই দেশের সংঘাতের পরিণতি ভবিষ্যতে কি হতে পারে? তাহলে কি আরও এক নতুন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চলেছে গোটা বিশ্ব?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সংঘাত কিন্তু নতুন নয়। বহু পুরোনো। কিন্তু সেখান থেকে আজ এই বর্তমান পরিস্থিতি, কোথা থেকে জল কতদূর গড়িয়েছে, কিভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? ১৯৫০ এর দশক থেকেই দেশ দুটোর সম্পর্কের টানপোড়েন চলছে। অশান্তির আগুন লাগিয়েছে সেই ‘তেল’। তারপর থেকে একের পর এক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের সম্পর্ক তিক্ততর হয়েছে। আর এই সংঘাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো “নিষেধাজ্ঞা”।
একটু মনে করে দেখুন, সম্প্রতি যে তেলের ট্যাঙ্কার আটকের ঘটনা ঘটেছে, সেক্ষেত্রেও কিন্তু বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইরানের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে তারই আওতায় একটা তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাস তারপরই শুরু। কি ঘটেছে তা হয়তো অনেকেরই জানা। কিন্তু আমরা জানাবো, নিষেধাজ্ঞা, সংকট আর তার পরিণতি। আসলে, ইরানকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে পর্যুদস্ত করতে গত শতকের আশির দশকের গোড়া থেকে বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এসছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে।
- ইরান থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়, ১২০০ কোটি ডলারের ইরানি সম্পদ আটক করে।
- ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইরানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের মদদদাতা বলে দাগিয়ে দিয়ে, দেশটার ওপর আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়।
- ১৯৯২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে বিল পাস হয়, উল্লেখ করা হয় এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেই সব সামগ্রী ও প্রযুক্তি ইরাক বা ইরানের কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করবে, যা দিয়ে তারা রাসায়নিক, জীবাণুবাহী, পারমাণবিক বা উন্নত মানের অন্য কোনো অস্ত্র তৈরি করতে পারে।
- ১৯৯৬ সালে ইরানের পেট্রোলিয়াম শিল্পে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
- এর ঠিক কয়েক মাস পর ইরান থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানি এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সব ধরনের পণ্য ইরানে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
- পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
- ২০০২ সালে ইরানের একটা বিরোধী দল দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন বিষয়টা ফাঁস করে দেয়, পারমাণবিক স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার বিষয়টি প্রকাশ করে দেওয়া হয়।
- এরপরই যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, পারমাণবিক কর্মসূচির আড়ালে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, মানে পারমাণবিক বোমা তৈরির ধান্দা আছে, যদিও ইরান তা অস্বীকার করে।
- ২০০৭ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও সাহায্য বন্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে।
পরে, সেই নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া আরও চেপে বসতে থাকে। ইউরোপীয় দেশগুলো ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিল। একের পর এক নিষেধাজ্ঞার চাপে ইরানি মুদ্রার বাজার মূল্য দুই-তৃতীয়াংশ যায় কমে। তবে, ২০১৩ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। ২০১৫ সালে ছয় দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি মিলে ইরানকে একটি চুক্তিতে নিয়ে আসে। এই চুক্তির অধীনে ইরান পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখতে রাজি হয়। চুক্তি অনুযায়ী পারমাণবিক বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর থেকে তুলে নেওয়া হয়! কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব থেকেই যায়। আর, তাই ইরান মাত্রাতিরিক্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে এই অজুহাতে ২০১৮ সালের মে মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে সরে আসেন! এরপর থেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ফের সাপে নেউলে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এককথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান যে পজিশন ডিজার্ভ করে সেখানে কিন্তু নেই। বিশ্বে তেলের মজুতে চতুর্থ বৃহত্তম দেশ ইরান, কাজেই নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তারা যে কতটা মজবুত অবস্থানে থাকত, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে, থেমে নেই ইরান। চুক্তি ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম মজুত করছে ইরান। আর এখানেই ভয় যুক্তরাষ্ট্রের। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কিছুতেই অবাধে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে দেবে না। ইরানও যেকোনো মূল্যে এ কর্মসূচিতে অটল থাকবে। এর ভবিষ্যৎ পরিণাম তাহলে কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন?
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের এই টক্কর বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। সশস্ত্র যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। আর পরিস্থিতি দিনে দিনে যেভাবে জটিল হচ্ছে তাতে সম্ভাবনা বাড়ছে বই কমছে না। যেমন, এই যে ঘটনাটা ঘটলো, ওমান উপসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী একটা তেলবাহী ট্যাংকার আটক করেছে ইরানের নৌবাহিনীর সদস্যরা! ট্যাঙ্কারটা কুয়েত থেকে মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি শেভরনের জন্য তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
আটক করার নেপথ্যে কারণ ও দর্শিয়েছে ইরান, কি বলেছে? ইরান বলেছে, আটক করার আগে অপরিশোধিত তেল বহনকারী ট্যাঙ্কারটা ইরানের একটি নৌযানকে ধাক্কা দেয়! ফলে, নৌযানের বেশ কয়েকজন ক্রু পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান, আহত হন অন্য ক্রুরা। এর পর ট্যাঙ্কারটা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়। রেডিওতে মেসেজ পাঠানো হলেও শোনেনি। এর আট ঘণ্টা পরে ট্যাঙ্কারটা আটক করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের এই পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে, বলেছে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। তবে, এটা যে ইরানের ইটের বদলে পাটকেল নীতি সেটা বেশ স্পষ্ট। কারণ, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইরানের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তার আওতায় একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটক করেছে। আর, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পরেই ইরান পাল্টা দিয়েছে। বলা যায় প্রতিশোধ নিয়েছে ইরান।
তবে, এই প্রথম নয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের একে অপরের ট্যাংক আটকের ঘটনার এমন নজির আরও আছে। আসলে, ইরান এখন নিজেদের লক্ষ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তাদের তেল রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এতেই যত আপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, বাড়তে থাকা উত্তেজনা বিশ্বকে কোনদিকে নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম