।। প্রথম কলকাতা ।।
Shaolin Kung Fu: পাখির মতো উড়ছে মানুষ, শূন্যে লাফিয়ে ভেসে যাচ্ছে অনেক দূর। ফুটন্ত জলে বসে চলছে ধ্যান। মানুষ দৌড়াচ্ছে জলের উপর দিয়ে। এটা কোন সিনেমা নয়, এক্কেবারে নিখাদ বাস্তব। ভাবছেন হয়ত, এ কি আদৌ সম্ভব? নিশ্চয়ই কোন গাঁজাখুরি ব্যাপার রয়েছে। আসলে এখানে রয়েছে এমন এক টেকনিক যার আঁতুর ঘর চীন, কিন্তু স্রষ্টা ভারতীয়। ভারতেই লুকিয়ে রয়েছে এই অসামান্য কসরতের শিকড়। বৌদ্ধদের আত্মরক্ষার পাঠ শেখাতেই কুংফু শিখিয়েছিলেন ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু। কুংফু নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শারীরিক নানান বিস্ময়কর কসরতের দৃশ্য। বর্তমানে চীন আর জাপানে কুংফু ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু কালের গর্ভে ভারত থেকে এই চর্চা প্রায় উঠে গিয়েছে।
চীনের শাওলিন টেম্পল, যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের রক্তে বয়ে চলেছে ধর্ম আর কুংফু। তামাম দুনিয়ার মার্শাল আর্টের মধ্যে সবথেকে মারাত্মক হল শাওলিন কুংফু। চীনে বিখ্যাত শাওলিন মন্দিরে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে কুংফুর চর্চা চলছে। সেই চর্চা দেখতে লক্ষ লক্ষ পর্যটক সারা পৃথিবীর প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন। শাওলিন কুংফুর ভিত্তি হল মানব দেহকে প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং প্রাণনাশক অস্ত্রে পরিণত করা। যে অস্ত্রের কাছে ধারালো অস্ত্র পর্যন্ত হার মানবে। আর এই অধ্যায়নের পিছনে রয়েছে অসীম ধৈর্য এবং শক্তি। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ধরনের মার্শাল আর্ট থাকলেও কুংফু একেবারে ব্যতিক্রমী ঘরানা। এই কুংফুর যাত্রা শুরু হয়েছিল ভারতীয় সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্রের হাত ধরে। প্রথম প্রথম এখানে সন্ন্যাসীদের প্রায় ১০০০টির মতো শৈলীর অভ্যাস হলেও, পরবর্তীকালে বেছে নেওয়া হয় সেরা বাছাই করা ১৮টি কুংফু শৈলী। বন্য ভয়ঙ্কর জীবজন্তু থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচাতে হবে তার টেকনিক রয়েছে শাওলিন কুংফুতে। শুধু তাই নয় সাপ, ভাল্লুক, বাঁদর, বেজি, বাঘ প্রভৃতি আক্রমণ করেই চোখের পলকে কীভাবে শত্রুর নাগালের বাইরে চলে যায়, সেই টেকনিকও শেখানো হয়। পাশাপাশি বজ্রপাত, বিস্ফোরণ, বন্যার মতো প্রাকৃতিক ঘটনা থেকে কীভাবে আত্মরক্ষা করা যায়, সেই টেকনিক কুংফুর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
চীনের হেনান প্রদেশের পাহাড়ি উপত্যকা ঘিরে রয়েছে জঙ্গল, ঝরনা আর উঁচু পর্বতশ্রেণী। অপরূপ মনোরম সুন্দর এক পরিবেশ একসময় বুদ্ধভদ্রকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি সং পর্বতের একটি গুহায় তপস্যা শুরু করেন। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় বহু মানুষ বুদ্ধভদ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তখন তাকে সবাই বলতেন ‘ফতুও বাতুও লও’ নামে। সময়টা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগ। সেই সময় চীন শাসন করছে ওয়েই রাজবংশ। সেই সময় সম্রাট জিয়াওয়েন বুদ্ধভদ্রকে পাকাপাকিভাবে চীনে থাকার জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন সুবিশাল শাওলিন মনাস্ট্রি। যা বর্তমানে এই সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত শাওলিন টেম্পল হিসেবে। ইউনেস্কো ২০০০ সালে এই টেম্পেলের সুউচ্চ কাষ্ঠ নির্মিত বৈধ প্যাগোডাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই মনাস্ট্রির প্রথম প্রধান ছিলেন বুদ্ধভদ্র। মন্দিটির চারিদিকে ছিল ঘন জঙ্গল। ভয়ঙ্কর দস্যু আর বিধর্মীদের হাত থেকে মন্দিরটি রক্ষা করতে বুদ্ধভদ্র সেই সময় তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন শুধুমাত্র ঈশ্বর সাধনা নয়, পাশাপাশি প্রয়োজন মানসিক এবং শারীরিক শক্তি সাধনার। তিনি নিখুঁতভাবে ভারতীয় মার্শাল আর্টের সঙ্গে মিশিয়ে দেন চাইনিজ মার্শাল আর্ট। যার ফলে সৃষ্টি হয় এক্কেবারে অন্য ঘরানার শাওলিন কুংফু।
বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যশালী মার্শাল আর্ট স্কুল হিসেবে পরিচিত। বুদ্ধভদ্রের অনুপ্রেরণায় এই টেম্পেলের সন্ন্যাসীরা এক অলৌকিক দক্ষতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। নিজেদের দেশ এবং ধর্মকে বাঁচাতে তারা এই অনন্য কুংফু টেকনিকে বারংবার মাত করেছে শত্রুদের। ৬১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রায় কয়েকশো ডাকাত রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে শাওলিন টেম্পলে আক্রমণ করে। কিন্তু ডাকাতরা জানতো না এখানে থাকা সন্ন্যাসীদের মধ্যে আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। কারণ তখন সন্ন্যাসীদের কুংফু প্রশিক্ষণ দেয়া হত গোপনে। তবে জানা যায়, সেই কয়েকশো ডাকাতের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন। সেদিন সারা পৃথিবী দেখেছিল শাওলিন সন্ন্যাসীর কুংফুর মারাত্মক ছোবল। এছাড়াও ৬২১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ওয়েনকে বাঁচাতে ঠিক একইভাবে শাওলিন সন্ন্যাসীরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হল, নিজেদের ধর্ম, দেশ এবং আত্মরক্ষা ছাড়া শাওলিন সন্ন্যাসীরা একটি প্রাণীকেও আঘাত করেননি।
আশ্চর্য সব টেকনিক
এখানে রয়েছে আশ্চর্য সব টেকনিক যেমন জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় হালকা প্লাইউড, যা জলে ভাসতে থাকে, তার ওপর দিয়ে দৌড়ে যেতে হয় সন্ন্যাসীদের। এই অত্যাধুনিক বৌদ্ধ মঠে উড়ন্ত সন্ন্যাসীদের দেখার জন্য আলাদা প্রেক্ষাগৃহের ব্যবস্থা করা আছে। মূলত এখানে রয়েছে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের খেল। গিয়ে দেখবেন ডানা নেই অথচ দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছেন সন্ন্যাসীরা। আসলে এখানে নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে বড় টারবাইন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। যার প্রচুর হাওয়ার চাপে উড়তে থাকেন সন্ন্যাসীরা। দর্শকরা সেই টারবাইন চোখে দেখতে না পেলেও তার তীব্র শব্দ কানে আসে। এখানেই রয়েছে ডায়মন্ড ফিঙ্গার নামক একটি টেকনিক। যেখানে শুধুমাত্র আঙুলের উপর ভর দিয়ে সারা শরীরকে উপরের দিকে তুলে ধরে থাকেন। সন্ন্যাসীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আঙুলকে শক্ত ধাতুর মতো তৈরি করেন। একইভাবে তাদের মাথাকেও ধাতুর মতো তৈরি করেন। অবলীলায় মাথার সাহায্যে ভেঙে ফেলেন শক্ত জিনিস।
ছাত্রদের সারা সপ্তাহ জুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনি
শাওলিন টেম্পল হল বিশ্বের অন্যতম মার্শাল আর্ট স্কুল। এখানে টিকে থাকা এক্কেবারেই সহজ কথা নয়। ভোর চারটের সময় থেকে ছাত্রদের দিন শুরু হয়। কয়েক ঘন্টা ধ্যানের পর করতে হয় কঠিন শারীরিক কসরত। মোট ৭২ টির মধ্যে ৩৬টি থাকে সোজা এবং বাকি ৩৬ টি হয় অত্যন্ত কঠিন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে হয়। নিজেদের সমস্ত কাজ করতে হয়, খেতে হয় খোলা আকাশের নিচে। রাত আটটা বাজলেই শুয়ে পড়তে হবে, তাও আবার হল ঘরের মেঝেতে পাতা কম্বলের উপর। সারা সপ্তাহ জুড়ে শুধু হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সপ্তাহে একবার মাত্র ১২ ঘণ্টার ছুটি মেলে ছাত্রদের।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম