বিশেষ কৌশল নিয়ে শুভেন্দু বিজেপির অপরিহার্য নেতা হয়ে উঠেছেন

।। প্রথম কলকাতা ।।
জননেতা কে? এককথায় এর উত্তর মানুষ যার সঙ্গে আছেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে জননেতা। ইদানিং সেটা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী (Subhendu Adhikari)। সবে মাত্র এক মাস হল তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন শুভেন্দু। এই সময়কালের মধ্যে তিনি নিজেকে গেরুয়া শিবিরের একজন অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করেছেন। অত্যন্ত সুকৌশলে শুভেন্দু এই কাজটা করতে পেরেছেন নতুন দলে এসে। শুভেন্দু ভালো করেই জানে বিজেপি অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। সেখানে নিয়ম-নীতি মেনে চলতেই হবে। দলের অনুশাসন সেখানে শেষ কথা বলে। তাই অক্ষরে অক্ষরে শুভেন্দু সেইসব নির্দেশ মেনে চলছেন। বিজেপিতে আসার পর শুভেন্দু এখনও কোনো দলীয় পদ পাননি রাজ্য বা কেন্দ্রীয় স্তরে। তা সত্ত্বেও শুভেন্দুকে বিজেপি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা বোঝা যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকায়।
শনিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে অনুষ্ঠানের আগে সকলে দেখেছে প্রধানমন্ত্রী শুভেন্দুর পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। গত ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুর কলেজ ময়দানে শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত ধরে। সেদিনই দেখা গিয়েছে জনসভার পর অমিত নিজের হেলিকপ্টারে তুলে নিয়েছেন শুভেন্দুকে। মেদিনীপুর থেকে একসঙ্গে তাঁরা কলকাতায় এসে বিশেষ সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দেন। অর্থাৎ গুরুত্বের নিরিখে প্রথম দিনেই একশোতে একশো পেয়েছেন শুভেন্দু। এটা স্বীকার করতেই হবে সকলকে। তারপর যতদিন গেছে ততই বিজেপির অন্দরে শুভেন্দুর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত শুভেন্দুকে সামনে রেখে অবিভক্ত মেদিনীপুর বা অন্যান্য জেলায় বিজেপি একটার পর একটা কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। সেখানে প্রতিটি জনসভার আগে শুভেন্দু অংশ নিচ্ছেন রোড শোতে।
কাঁথি, সবং, পুরুলিয়ার কাশীপুর, রামনগর, দাঁতন এরকম বহু জায়গায় শুভেন্দুর রোড শো তথা মিছিলকে ঘিরে জনপ্লাবন দেখা দিয়েছে। আর রোডশো’র পর প্রতিটি সভা থেকে শুভেন্দু ব্যাপক আক্রমণ করছেন তৃণমূলকে। সেক্ষেত্রে তাঁর আক্রমণের মূল নিশানায় সব সময় থেকেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপিতে যোগদানের পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নতুন দলে নিজেকে সেট করে নিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে শুভেন্দু বেশ কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন বিজেপির মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের ক্ষেত্রে রাজ্য সভাপতির গুরুত্ব কতটা। রাজ্য সভাপতির পাশাপাশি জেলা সভাপতি তথা অন্যান্য শীর্ষ নেতারা দলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। শুভেন্দু ভালো করেই জানেন সেটা। তাই প্রতিটি জনসভায় বক্তব্য রাখার শুরুতে শুভেন্দুর মুখে শোনা যাচ্ছে জেলা নেতাদের কথা।
শুভেন্দু মুক্তকণ্ঠে তাঁদের প্রশংসা করছেন। সব জায়গায় বলছেন, আপনারাই বিজেপিকে আজ এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। আমি আরও একটু এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব মাত্র। প্রয়োজনে আমি দেওয়াল লিখব, ঝান্ডা লাগাব। যখন মনে করবেন জেলা নেতৃত্বকে জানাবেন। তাঁরা অনুমতি দিলেই সেখানে ছুটে যাব। আর রাজ্য সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে শুভেন্দু বলছেন, লালমাটির দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh) এবং বালুমাটি শুভেন্দু অধিকারী এক হয়েছি। আমরা বিজেপিকে দুশোর বেশি আসনে জিতিয়ে আনব। প্রতিটি জনসভায় দিলীপ ঘোষের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন তিনি। পাল্টা দিলীপ বলেছেন, রাম- লক্ষণ এক হয়েছি। তৃণমূলের বিদায় আসন্ন। এভাবেই শুভেন্দু অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন বিজেপিতে আসার পর। মনে রাখতে হবে তৃণমূলে থাকার সময় দলের বাইরে গিয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুরের পাশাপাশি বাঁকুড়া, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলায় শুভেন্দুর একটা নিজস্ব সমান্তরাল সংগঠন ছিল। সেটা শুভেন্দু এখন বিজেপির পক্ষে সুন্দর ভাবে ব্যবহার করছেন।
তাই প্রতিটি রোড শোতে জনপ্লাবন দেখা যাচ্ছে। শুভেন্দুকে নিয়ে বিজেপি কর্মী সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উৎসাহ, উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। সবচেয়ে বড় কথা তৃণমূলকে তিনি রাজনৈতিক আক্রমণ করছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে একবারের জন্যও ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি। এটা তাঁর ক্ষেত্রে একটা বড় প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুভেন্দু দল ছাড়ার পর সেই পথ ধরে আরো অনেকে বিজেপিতে আসবেন এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অর্থাৎ শুভেন্দুর টিআরপি গেরুয়া শিবিরে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। বিজেপি এতদিন স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করত জয় শ্রীরাম এবং ভারত মাতা কি জয়। সেখানে শুভেন্দু আসার পর নিজের থেকে নতুন স্লোগান তুলেছেন। কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, বিজেপি সবার ঘরে ঘরে। এই শ্লোগান সব জায়গায় দিচ্ছেন তিনি।
দেখা গিয়েছে দলের এক শীর্ষ সাংগঠনিক নেতা এই স্লোগান নিজের ফেসবুক পোস্টে ট্যাগ করেছেন। অর্থাৎ এই শ্লোগান ব্যবহারে কার্যত গেরুয়া শিবির শুভেন্দুকে মান্যতা দিয়েছে। সব মিলিয়ে শুভেন্দু এখন ছুটছেন কার্যত রকেটের গতিতে। ইতিমধ্যেই তিনি পেয়েছেন জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান পদ। এখানে কাজ করে শুভেন্দু কৃষক সমাজকে বিশেষ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কারণ রাজ্যে কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৭৩ লক্ষ। অর্থাৎ বিধানসভা নির্বাচনে কৃষকদের ভোট অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। সব মিলিয়ে চিন্তাভাবনা করে শুভেন্দু বিজেপিকে নিজের সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দরভাবে মিশিয়ে নিতে পেরেছেন দ্রুততার সঙ্গে। যেটা আগে দেখা যায়নি মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখ নেতা-নেত্রীদের ক্ষেত্রে। এখানে নিজের ব্যক্তিগত ইমেজকে কাজে লাগিয়ে গেরুয়া শিবিরে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে উঠেছেন শুভেন্দু।