।। প্রথম কলকাতা ।।
Boiling River: নদীর জল টগবগ করে ফুটছে, সেখান থেকে সমানে উড়ছে ধোঁয়া। কোন প্রাণী ভুলেও যদি এই নদীতে নামে, মুহূর্তে তার প্রাণ যাবে। সেদ্ধ হতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট। পৃথিবীতেই রয়েছে এমন এক ফুটন্ত নদী। যে নদীর কাছে যাওয়াও বারণ। এই ফুটন্ত নদীকে কেন্দ্র করে রয়েছে নানান রহস্যের বেড়াজাল, যা ভেদ করতে বারংবার বহু মানুষ সেই নদীর কাছে ছুটেছেন। এই নদীর কাছেই নাকি ঘুরে বেড়ায় আত্মারা। যার নেপথ্যে রয়েছে প্রচুর কাহিনী। সবাই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠে সাধারণত ঠাকুমা দাদুর কাছ থেকে কিছু রূপকথার গল্প শুনে। সেই রূপকথার গল্পকেই সত্যি প্রমাণ করেছিলেন আন্দ্রে রুজো। দাদুর মুখে শোনা টগবগে ফুটন্ত নদীর কাছে পৌঁছে গেছিলেন তিনি। যে নদীতে ভেসে বেড়ায় সেদ্ধ হওয়া নানান প্রাণী। পেরুর বয়স্ক মানুষদের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে বয়েলিং বা ফুটন্ত নদীর কথা। যা সেখানকার আঞ্চলিক শিশুরা গল্প আকারে শুনতে ভালোবাসেন। এমনি থেকেই আমাজন জঙ্গল রহস্যময়। এই ঘন জঙ্গলে অনেকেই প্রবেশ করতে ভয় পান। আর সেই ভয়কে জয় করে জীবন হাতে নিয়ে ২০১১ সালে ভূতত্ত্ববিদ আন্দ্রে রুজো ফুটন্ত নদীর রহস্য উন্মোচন করেন।
আন্দ্রে রুজোর (Andres Ruzo) শৈশব কেটেছিল পেরুর লিমায়। ছোট্ট আন্দ্রে দাদুর মুখে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন ফুটন্ত নদীর কথা। সেখানে থাকা নানান আত্মাদের অস্তিত্বের কথা। যেখানে একা যেতে প্রায় অনেকেই ভয় পেতেন। একটু বড় হতেই আন্দ্রে সেই নদী পিছনেই ছুটলেন। এই নদী নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানান লৌকিক কাহিনী। যা শুনলে রীতিমত অনেকেরই গায়ে কাঁটা দেয়। এই নদীর কাছেই বসবাস করে দুটি উপজাতি। একটি মায়ানতুয়াকু, অপরটি হল সানতুয়েরিয়ো। ফুটন্ত নদীর নাম আঞ্চলিক ভাষায় মায়ানতুয়াকু।
নদীর ধারেই বাস আত্মাদের !
মায়ানতুয়াকু (Mayantuyacu) শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় দুটি শব্দ। মায়ানতু এবং ইয়াকু। আঞ্চলিক মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মায়ানতু হলো জঙ্গলে থাকা একটি উপকারী আত্মা। জঙ্গলে নাকি অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তাদের মধ্যে মায়ানতু এমন এক বিশেষ শক্তি ,যা তাদেরকে রক্ষা করে। যার মাথা ব্যাঙের মতো দেহটি টিকটিকির মতো এবং হাত পা গুলি কচ্ছপের মত। অপরদিকে ইয়াকু কথার অর্থ জল। আর এই জঙ্গলের ফুটন্ত নদীটি সৃষ্টি করেছেন ইয়াকুমামা (Yacumama) নামক সাপের মত দেখতে একটি আত্মা। এই আত্মাটির জন্ম গরম এবং ঠাণ্ডা জলের মিশ্রণে, যিনি সবসময় মানুষের কল্যাণ করেন।
ভূতত্ত্ববিদ আন্দ্রে রুজো এই ফুটন্ত জলের রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন এবং সেই নিয়ে লেখেন “দ্য বয়লিং রিভার : অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ডিসকভারি ইন দ্য অ্যামাজন” নামক বই। আন্দ্রে নদীটির কাছে পৌঁছে দেখেন, প্রচুর প্রাণী মরে ভাসছে। জলের তাপমাত্রা প্রায় ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে। জল থেকে উঠছে ধোঁয়া, কোন প্রাণী ভুলবশত জলে পড়লে তার আর নিস্তার নেই। এই নদীর কাছে পৌঁছাতে আন্দ্রের কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। কারণ আঞ্চলিক মায়ানতুয়াকু জাতি ফুটন্ত নদীর কাছে কাউকে বিশেষভাবে পৌঁছাতে দেন না। কারণ স্থানীয়রা এই নদীর জল ঔষধ হিসেবে বিক্রি করেন। কিছু প্রতিনিধি এই নদীকে সভ্য জগতের আলো থেকে লুকিয়ে রাখতে চান। প্রথমেই আন্দ্রে ভেবেছিলেন, হয়ত আশেপাশে কোন আগ্নেয়গিরি রয়েছে। অনেক সময় আগ্নেয়গিরির লাভা চুঁয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং জল গরম করতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় নদী থেকে আগ্নেয়গিরি রয়েছে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে। যা জল গরম করতে একেবারে ব্যর্থ।
আন্দ্রের মতে নদীর জল ফুটন্ত হওয়ার একটাই কারণ, ফল্ট লেড হাইড্রোথার্মাল ফিচার। নদীর জল প্রথমে মাটির ভিতরে প্রবেশ করে অত্যন্ত গরম হয় এবং আবার সেই গরম জল উপরের দিকে উঠে আসে। এটাই ক্রমাগত সার্কেল আকারে চলতে থাকে। অপরা কারণ হলো বেআইনি তৈল ক্ষেত্র। নদীর আশেপাশে অনেক অসাধু ব্যবসায়ীরা গাছপালা কেটে তৈল ক্ষেত্র বানানোর কারণে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে নদীর জল গরম হচ্ছে। কিংবা হয়তো নদীর নিচে রয়েছে কোন উষ্ণ প্রস্রবণ।
নদীটি কেমন?
সেন্ট্রাল পেরুভিয়ান আমাজন জঙ্গলের নিম্নাংশে অবস্থিত এই নদীটি প্রায় ৮২ ফুট চওড়া। গভীরতা প্রায় ১৬ থেকে ২৫ ফুট। নদীটির দুধারে জঙ্গল রয়েছে প্রায় ৬০ ফুট উঁচুতে। নদীর জল ফুটন্ত, ধোঁয়া উঠছে, বুদবুদে ভরা সেই জলে ভাসছে সেদ্ধ হওয়া প্রাণী। প্রায় ৯ কিলোমিটার বিস্তৃত এই উষ্ণ নদীর ৬.২৪ কিলোমিটার স্থানের জল অত্যন্ত বেশি গরম। আজও এই আমাজনের ফুটন্ত নদীকে নিয়ে নানান রহস্যের বেড়াজাল রয়ে গেছে মানুষের মনে।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম