‘বন্দেমাতরম’ গেয়ে বন্দি হয়েছিলেন ব্রিটিশের হাতে, মৃণাল পরিচালনায় প্রাণ পেয়েছিল নাগরিক যন্ত্রণা

।। প্রথম কলকাতা ।।
দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অবিচল বিশ্বাস রেখে, তাকে সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন একদল যুবক। আনতে চাইতেন এক নতুন বিপ্লব। সেই বন্ধুদলে ছিলেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, বংশী চন্দ্র গুপ্ত, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, নৃপেণ গঙ্গোপাধ্যায় আর মৃণাল সেন (Mrinal Sen)। সেই সময়ের ভারতীয় সিনেমাকে কার্যত অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হতো তাঁদের। নিজেদের সৃষ্টি দিয়ে বাংলা ছবিতে তাঁরা বিশ্বমানের স্পর্শ আনতে চাইতেন। সেই থেকেই ভাবনার বীজ পোঁতা হয় মৃণালের বুকে। এমনিতেই তারুণ্যের উৎসাহ, তার উপর বিপ্লবের স্বপ্ন। বিফলে যায়নি কিছুই। আজ স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষপূর্তিতে এসে ফিরে দেখা কিংবদন্তী পরিচালক মৃণাল সেনের পথচলা।
১৯২৩ সালের ১৪ মে, বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম তাঁর। সেখানেই কাটিয়েছেন প্রথম ১৭টা বছর। বাবা দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন নামকরা আইনজীবী। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলেজে পড়তে কলকাতায় আসেন মৃণাল। পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও লাভ করেন। তবে পদার্থবিদ্যার ছাত্র হলেও তাঁকে টানত সাহিত্য। তাই লেখার জগতে তাঁর ছিল অপরিসীম টান। কলেজে থাকাকালীনই কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আজীবন কমিউনিস্ট জীবনচর্যায় বিশ্বাস রেখে গেছেন। কিন্তু তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় পদ গ্রহণ করেননি।
১৯৪৩ সালে সমাজবাদী সংস্থা আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপ্লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরে সাংবাদিকতা, ওষুধ বিক্রি, সিনেমায় শব্দকুশলী- এমন নানা রকম কাজ করেন। ভর্তি করেন অভিজ্ঞতার ঝুলি। তবে তখনও কেউ জানত না, সিনেমা তৈরি করেই জগদ্বিখ্যাত হবেন তিনি! বরং সিনেমার ব্যাপারে নিজেও খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। তবে সাউন্ড রেকর্ডিং এর ওপর তাঁর ঝোঁক ছিল। সেই সূত্রেই একটি স্টুডিওতে সাউন্ড রেকর্ডিং এর কাজ শিখতে যান তারপর সেখানে কিছুদিন কাজও করেন। এরপরই তিনি স্থির করেছিলেন ছবির জগতে পা রাখবেন। শুরু হয়েছিল শ্যুটিং।
আরো পড়ুন : মর্মান্তিক! গাড়ি দুর্ঘটনায় নিমেষে ঝলসে গেলেন প্রিয়াঙ্কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘অ্যানে হেচে’, ভাইরাল ভিডিও
১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিলো তাঁর প্রথম ছবি রাত-ভোর। তাঁর দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নিচে স্থানীয় পরিচিতি এনে দিলেও, স্বপ্নপূরণ হয় তৃতীয় ছবিতে, ১৯৬০ সালে বাইশে শ্রাবণ ছবি থেকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি তৈরি হয়েছিল পরিচালকের। ১৯৬৯ সালে ভূবন সোম ছবি তাঁকে চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যায়।
বরাবর নিজেকে কাটাছেঁড়া করতে ভালোবাসতেন তিনি। ছবির মধ্যে দিয়েই পরিচয় করিয়েছিলেন এক চীনা ফেরিওয়ালার সাথে। যে এ দেশকে তারই দেশ ভেবে ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে পড়ে। দর্শকদের দেখান ‘নীল আকাশের নীচে’। তবে ছবিটির আঙ্গিক ও প্রতিন্যাসে তেমন কোনও অভিনবত্ব ছিল না। তৃতীয় পদক্ষেপ ‘বাইশে শ্রাবণ’ তাঁকে পৌঁছে দেয় আন্তর্জাতিক পরিসরে। তিনি দেখালেন সমাজ ও সময়- যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ মানুষের মধ্যে সম্পর্কবোধে মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটায়, যেখানে পরিবারের মধ্য দিয়ে তাকালে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে, সময় কী বলছে বোঝা যায়। সম্ভবত ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে এই ছবিটিতেই প্রথম নারীস্বাধীনতার প্রসঙ্গ প্রকৃত অর্থে ধরা পড়ে।
এরপর ১৯৬১-তে বানালেন ‘পুনশ্চ’। বাইশে শ্রাবণ’-এর গ্রাম থেকে এবার তিনি তাকালেন শহরের দিকে। দেখালেন সেখানেও ঘটছে একই ঘটনা। ১৯৬২-তে সমাজের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে মজা করে কমেডি আঙ্গিকে বানালেন ‘অবশেষে’। মেয়েদের আপাত সামাজিক ভয়-ভীতি ও সংস্কার মুক্ত হতে হবে এই নির্দেশ দিয়ে ১৯৬৪-তে বানান ‘প্রতিনিধি’। ১৯৬৫-তে বানানো ‘আকাশ কুসুম’-এ তিনি নায়ক অজয়ের মধ্য দিয়ে সমালোচনা করেন পেটি বুর্জোয়া ব্যবস্থার। ১৯৬৬ তে ওড়িয়া ভাষায় বানিয়েছেন বানিয়েছেন কৃষক পরিবারের যৌথ সংসারের সমস্যা নিয়ে ‘মাটির মনিষ’। কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প। ১৯৬৭-তে ভারতীয় ইতিহাসের পাঁচ হাজার বছর-এই বিষয় নিয়ে ‘মুভিং পারস্পেকটিভ’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানান। ১৯৬৯ সালে হিন্দি ভাষায় বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে, উৎপল দত্ত, সুহাসিনী মুলে’কে নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘ভুবন সোম’। ১৯৭০ সালে বানান রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি ‘ইচ্ছেপূরণ’ শিশুচিত্র।
এরপর ১৯৭১ সালে ‘ইন্টারভিউ’, ১৯৭২ সালে ‘কলকাতা ৭১’, ১৯৭৩ সালে ‘পদাতিক’ এর মধ্যে দিয়ে শহর কলকাতার নকশালবাড়ির আন্দোলনের রসায়ন গড়ে উঠেছিল তাঁর কলকাতা ট্রিলজিতে। এই ট্রিলজির মধ্যে দিয়েই তুলে ধরেছিলেন গোটা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এছাড়াও তাঁর কালজয়ী সিনেমা গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০), ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘খারিজ’ (১৯৮২)। ১৯৮৩ সালে এই ছবির জন্যে আন্তর্জাতিক কান ফেস্টিভ্যালে বিশেষ জুরি পুরস্কারে সম্মানিত হন মৃণাল সেন। এছাড়াও রয়েছে তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য ছবি মৃগয়া’, ‘কোরাস’ ‘মহাপৃথিবী’, ‘অন্তরীন’, ‘চলচ্চিত্র’, ‘এক দিন আচানক’, ‘কান্দাহার’, ‘পরশুরাম’, ‘চালচিত্র’।
২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির জন্য সম্মানিত হয়েছেন পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে সম্মানে, ফ্রান্স ও রাশিয়া থেকেও পেয়েছে সরকারি সম্মান। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রয়াত হন পরিচালক। আজ সংরক্ষণের অভাবে তাঁর বহু ছবি হারিয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় রয়ে গেছে তাঁর উজ্জ্বল সৃষ্টি। সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা ও নান্দনিক দক্ষতা-এই দুইয়ের মিশেলে বাংলা সিনেমার জগতে যে ঐতিহাসিক বেঞ্চমার্ক তৈরি করেছেন তিনি, তাকে আজও কুর্নিশ জানায় গোটা বিশ্ব।
খবরে থাকুন, ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
সব খবর সবার আগে, আমরা খবরে প্রথম